বাংলা
ব্লগ পোস্ট # ৩৮; ৩০.১০.২০১৭:ঠাকুরের ভালবাসার ব্যক্তিগত অনুভূতি: শ্রীমতি নীনা রেওয়াল, নিউ জার্সি (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র)
ব্লগ পোস্ট # ৩৮; ৩০.১০.২০১৭
ঠাকুরের ভালবাসার ব্যক্তিগত অনুভূতি – শ্রীমতি নীনা রেওয়াল, নিউ জার্সি (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র)
(নিজের বোন শ্রীমতি তৃপ্তি পারিখকে দেওয়া আখ্যানের ভিত্তিতে)
বাংলা অনুবাদ: তিলক ঘোষাল
আমি হরনাথ প্রাণ শ্রী উমাশঙ্কর খাম্বোলজার নাতনি হবার দুর্লভ সৌভাগ্যের সাথে সাথে নিজের জীবনে বাবা (ঠাকুর হরনাথ) এবং মা (কুসুম কুমারী দেবী) এর অসীম কৃপা, ভালবাসা পাওয়ার সৌভাগ্যেরো অধিকারিণী। এই মঞ্চে তারই ককেকটা উদাহরান কুসুমহরনাথ ভক্তব্রন্দের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। আজ বলি দু’টি ঘটনা।
প্রথম ঘটনা
আমার বিয়ের পর আহমেদাবাদের বাপের বাড়ি ছেড়ে বসবাস আরম্ভ করলাম পুনের কাছে ভর নামে এক গ্রামে স্বামীর বাড়িতে। ধীরে ধীরে সংসার পাতলাম। কয়েক বছরে আমাদের দুটি সন্তানও হল – একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। এই ভাবে কেটে গেল বহু বছর আমাদের অজান্তেই। শেষে ১৯৯৯ সালে কিছুটা সময় হ’ল এবং আমরা চার জন ছুটি কাটাতে আর আমার বাপের বাড়ির সকলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আহমেদাবাদ। সেই সময়ে আমার চোখে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তাই আমার দিদি মনীষাবেন আমাকে সেখানকার এক আই স্পেশালিষ্টের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বললেন আমার দু চোখেই ছানি পড়ছে এবং তা আর একটু পাকলেই অপারেশন করতে হবে। আমার ভাই পরিতোষ একটা দ্বিতীয় মতামতের জন্যে নিয়ে গেল আর এক স্পেশালিষ্টের কাছে। তিনিও সব দেখে শুনে একই মত দিলেন – দু’ চোখেই ছানি পড়েছে এবং তা অপারেশন করে বার করতে হবে। যখন দুই বিশেষজ্ঞই একই রায় শোনালেন, বুঝলাম অপারেশন থেকে নিষ্কৃতি নেই।
এর কিছুদিন পর আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। আর ফেরার কয়েকের মাসের পরেই মাথায় বজ্রাঘাত হল। আমার স্বামীর হটাতই একটা ভয়ঙ্কর হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেলাম। স্বামী হারানোর যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে সামনে দেখছিলাম মাত্র ৯ আর ৭ বছরের দুটি কচি সন্তানকে একা হাতে বড় করে তোলার দায়িত্বের বিভীষিকাময় ভবিষ্যৎ। আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে সে ভবিষ্যৎ দেখাচ্ছিল আরও অন্ধকারময়। আর তার ওপর মাথায় ঘুরে চলছে কি করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে একা ফেলে নিজের চোখের অপারেশনের জন্যে পুনে যাব। একেবারে দিশেহারা অবস্থা।
এই রকম যখন মানসিক তখন বাবা আর মায়ের পায়ে পড়া ছাড়া আর কিই বা করে কুসুমহরনাথ আশ্রিতরা। আরম্ভ হল রোজ তাঁদের কাছে কান্নাকাটি আর কাকুতি মিনতি। এ ভাবে চলতে চলতে এক দিন হটাতই মনের পর্দায় ভেসে উঠলো একটা ছবি। তাতে দেখছি আমার দিদি মনীষাবেন এসেছেন আমাদের বাড়িতে বাচ্চা দুটোর দেখাশোনা করতে, আমি পুনের সেই হাসপাতালের একটা বেডে শুয়ে আছি অপারেশনের অপেক্ষায় আর ছোট বোন অঞ্জু একটা চেয়ারে আমার কাছে বসে। তারপর দেখছি ঠাকুর আর মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আর আমি বলছি – ‘দেখ, দেখ অঞ্জু, বাবা নিজের হাতে আমার চোখের অপারেশন করে সেলাইটাও কেটে দিয়েছেন’। …….ক্রমাগত পরপর চারদিন ধরে চোখের সামনে অবিরত ভেসে উঠতে লাগলো সেই ছবি। আর তার পর যেমন হটাতই আরম্ভ হয়ে ছিল, তেমনি আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল তা।……………ধীরে ধীরে ঘর সংসার চালানো, ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলার গুরু দায়িত্বের চাপে চোখের অপারেশনের ব্যবস্থা করার চিন্তাও পিছু হাটতে থাকল। প্রায় ১০ বছর পর, ২০০৯ সালে শেষে একটু সময় হল। পুনের সেই আই স্পেশালিষ্টের সঙ্গে আবার দেখা করলাম। ডাক্তার বাবু অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অবাক মুখে বললেন চোখের সেই ছানি দুটো আর নেই !! দুই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আলাদা আলাদা ভাবে পরীক্ষা করে ১০ বছর আগে যে ছানি দুটোর অপারেশনের কথা বলেছিলেন, সে দুটো বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল? ডাক্তারবাবু অবাক হলেও আমি তো বুঝলাম কে সেই সার্জেন যিনি সেই দুটোকে বার করে দিয়েছিলেন !!
দ্বিতীয় ঘটনা
একা হাতে ছেলে মেয়েকে বড় করা আর সংসার ছালন ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ায় আমি তাদের নিয়ে আমেরিকা চলে আসি আর নিউ জার্সির একটা শহরে, যেখানে আমার বোন তৃপ্তি আর ভাই আশিস থাকত, সেখানেই বসবাস আরম্ভ করি। খরচ খরচা চালানোর জন্যে নিউ ইয়র্ক শহরে একটা ছোট কাজও ধরে নিই। রোজ একটা বিশেষ ট্রেন ধরে নিউ জার্সির বাড়ি থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছুতাম আর কাজ শেষ সেই রকমই একটা ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতাম। রাস্তাঘাট জানার মধ্যে শুধু ব্যস এ’টুকুই। ২০১৬ সালের কথা। সেদিন যখন কাজ থেকে ফিরছি এমন সময়ে হটাতই আকাশ কালো করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে উঠতে লাগলো। হুড়মুড় করে স্টেশনের দিকে ছুটলাম ট্রেনটা ধরতে। আর সেই তাড়াহুড়োতে খেয়াল করিনি যে আমি একটা ভুল গাড়িতে উঠে পড়েছি। ভুলটা বুঝতে পারলাম যখন ট্রেনটা পরের স্টেশনে এলো। ভয়ে হাত, পা পেটে সিধিয়ে গেল। কি করবো কিছু মাথায় আসছে না। কোন সহযাত্রীর সাহায্য যে নেব সে সাহসও হচ্ছে না কারণ ভাষার অন্তরায় কতটা যে নিজে বোঝাতে পারব আর কতটা তাদের কথা ঠিকভাবে বুঝবো সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। যখন মনের এই অবস্থা ঠিক সেই মুহূর্তে দেখি উজ্জ্বল হাসি মুখে একটি তরুণ ছেলে এগিয়ে এসে বলল – “কোন চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে বাড়ির ঠিক পথ দেখিয়ে দেবো।”। তার পিছু পিছু পরের স্টেশনে নেবে পড়লাম আর উল্টো দিকের প্লাটফর্মের দিকে এগোতে লাগলাম। আগে পায়ের একটা অপারেশন হওয়ার দরুন আমি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিলাম। ওর সঙ্গে তাল রাখতে পারছিলাম না। সে কিন্তু বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে হাসিমুখে আমার ওপর সমানে নজর রেখে এগোচ্ছিলো। প্লাটফর্মে তো পৌঁছুলাম, কিন্তু ঢুকতে গেলে তো পাসটা স্ক্যান করলে তবেই গেটটা খুলবে। আমার কাছে তো অন্য রুটের পাস। সেই মিষ্টি ছেলেটা হেসে বলল – “ঘাবড়াবেন না। আমার কাছে মেট্রো পাস আছে। ওটা স্ক্যান করে আপনাকে পার করিয়ে দিচ্ছি”। আমি বললাম – “তুমি এসো আমার সঙ্গে”। সে বলল – “আপনি আগে যান, আমি আপনার পিছনেই আছি”। ও নিজের পাসটা স্ক্যান করতেই গেটটা খুলে গেল আর আমি প্লাটফর্মে ঢুকেই পিছু ফিরে তাকালাম সেও গেট পেরিয়ে ঢুকেছে দেখবো এই আশায়। কিন্তু কোথায় সে ছেলে? যতদূর দৃষ্টি যায়, এদিক, ওদিক সব দিকেই দেখলাম। তার কোন চিহ্নমাত্র কোনদিকে দেখতে পেলাম না।……ব্যাপারটা খানিক পরে বোধগম্য হল…………….আমার হরগোপালের চোখ যে আমার মনে গাঁথা। তাই আমি জানি আবার পথ হারানোকে সে’দিন পথ দেখাল সেই। আমি ধন্য যে বাবা আর মায়ের উপস্থিতি আর তাঁদের সঙ্গ সব সময়ে, সব যায়গায় অনুভব করি। এই রকমই আরও কয়েকটি অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে রইল………কুসুমহর
ব্লগ পোস্ট # ৩৭; ০৫/০৯/২০১৭ - “ভক্তের প্রতিজ্ঞা ভগবান রাখেন”: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভক্ত
ব্লগ পোস্ট # ৩৭; ০৫/০৯/২০১৭
“ভক্তের প্রতিজ্ঞা ভগবান রাখেন”: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভক্ত
আমার বাড়ি, ঠাকুরের মন্দির আর আমার অফিসের অবস্থানটা একটা ত্রিভুজের আকারে। একদিন রাত্রে হটাতই পরের দিন অফিস যাওয়ার পথে মা আর ঠাকুরের দর্শন করে যাবার একটা প্রবল ইচ্ছে জাগল মনে। যেহেতু সব মিলিয়ে বেশ ঘুরপথ হবে (মন্দির থেকে অফিস প্রায় ২০ কিমি রাস্তা), সেদিন অন্যদিনের তুলনায় অনেক আগেই বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে যাতে দর্শন করে অফিসও ঠিক সময়ে পৌছুতে পারি। কিন্তু মন্দিরে পৌঁছে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল যখন দেখলাম ঠাকুর আর মায়ের গলায় পাতলা আর বিবর্ণ একটা করে মালা। আমি তৎক্ষণাৎ মা আর ঠাকুরের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম যে আগামী একমাস প্রতিদিন নিজের হাতে ভালো একটা করে মালা ওনাদের পরাবো। চট করে বেরিয়ে কাছের ফুলের দোকান থেকে দুটো বড়সড় সুন্দর মালা এনে মা আর ঠাকুরকে পরিয়ে দিলাম। এই সেবাটা করতে পাড়ায় মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। সেদিন থেকে আরম্ভ হল প্রতিদিন সক্কাল সক্কাল উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে মন্দিরে পৌঁছুন। সেখানে দুটো ভালো মালা কিনে ঠাকুর আর মাকে পরিয়ে তারপর অফিস রওনা হওয়া। কিন্তু ভাগ্যে এ সুখ বেশিদিন লেখা ছিল না। কদিন পরই অফিসে আদেশ এলো যে একটা জরুরি কাজে আমাকে এক সপ্তাহের জন্যে কাণ্ডলা (গুজারাত) যেতে হবে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল যে তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিটা রাখতে পারা যাচ্ছে না ভেবে। আর যেহেতু আমি আমার এই খামখেয়ালি ইচ্ছেটা আর কাউকে বলতে সঙ্কোচ করছিলাম, সে জন্যে আমার অবর্তমানে মালা কিনে পরাবার জন্যে কোন টাকাকড়িও কাউকে দিয়ে গেলাম না। আরেকটা কারণও অবশ্য ছিল – এ সেবাটা আমি নিজেই করতে চাইছিলাম – অন্য কারুর হাতে দিতে মন ছাইছিল না। হয়তো খানিকটা স্বার্থপরের মত চিন্তা, কিন্তু তা হোক। সুযোগটা আমি অন্য কাউকে দিতে চাই নি। কাজেই মা আর ঠাকুরের কাছে প্রতিজ্ঞা না রাখতে পারার জন্যে আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রওনা দিলাম কাণ্ডলার পথে। কিন্তু যন্ত্রণার এখানেই শেষ নয়। কদিন কাণ্ডলায় কাজের পরে জানা গেল আরও একটা সপ্তাহ থাকতে হবে সেখানে। মন খারাপ হলেই বা উপায় কি। শেষমেশ ৭ দিনের যায়গায় ১৫ দিন পর ফিরলাম। শহরে পৌঁছে বাড়ি না গিয়ে সোজা চলে গেলাম মন্দিরে তাঁদের দর্শনের জন্যে। সেখানে পৌঁছে আমি হতবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম দুটো বড়বড় দুটো সুন্দর গোলাপ ফুলের মালা গলায় কি অপরূপ লাগছে দু’জনকে । স্তব্ধ হয়ে শুধু তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। সম্বিত ফিরল পূজারির ডাকে। আর তিনি যা বললেন, তাতে অভিভূত হয়ে আমার দু চোখে নামলো অবারিত অশ্রু ধারা – আর আমি লুটিয়ে পড়লাম মা আর ঠাকুরের পায়ে। পূজারি যা বলেছিলেন তা হল এই রকম:- কোন এক ভক্ত দম্পতির অনেক বছর পরে সন্তান লাভ হয় আরে তারই কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে তারা ঠিক করে যে তারা প্রতিদিন ঠাকুর আর মাকে বড় গোলাপের মালায় সজ্জিত করবে এক মাস ধরে – আমি যেদিন কাণ্ডলা রওনা হই ঠিক তার পর দিন থেকেই !! আর সেই থেকে তাঁদের গলায় আমার প্রতিজ্ঞার মালা !! একি নেহাতই কাকতালীয়? না তাঁদের নিজ ভক্তের প্রতি অন্তহীন ভালবাসার নিদর্শন? ঠাকুর তাঁদেরই দেওয়া আমার প্রতিজ্ঞা যাতে অসফল না হয় তার জন্যে নিজেই করে নিলেন সে ব্যবস্থা !! এ যদি নিখাদ ভালবাসা না হয়, তো ভালবাসা কি আমার জানা নেই।
ব্লগ পোস্ট # ৩৬; ১১/০৬/২০১৭ - “প্রতিশ্রুতি পূরণের মূর্ত প্রতীক - আমাদের ঠাকুর: গুণময় মুখোপাধ্যায়, সোনামুখি
ব্লগ পোস্ট # ৩৬; ১১/০৬/২০১৭
“প্রতিশ্রুতি পূরণের মূর্ত প্রতীক – আমাদের ঠাকুর: গুণময় মুখোপাধ্যায়, সোনামুখি
(শ্রী গুণময় মুখোপাধ্যায়ের মৌখিক বর্ণনার ভিত্তিতে তিলক ঘোষালের লেখা)
যেহেতু দাদু (আমার মাতামহ) শ্রী কুলদা রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মত আমিও রেল চাকরী করতাম, মামার বাড়ি গেলেই দাদুর আর আমার মধ্যে এটা নিয়ে অনেক কথা হ’ত। উনি স্মৃতি রোমন্থন করতেন ওনার সময়ের নানান বিষয়ে আর আমার কাছ থেকে খুব কৌতূহল ভরে জানতে চাইতেন আমার সময়ের রেলের বিভিন্ন বিষয়ে।
একদিন সেই কথাবার্তা চলাকালীন দাদু জিজ্ঞেস করলেন – “হ্যাঁরে এখন তোদের স্টেশন মাস্টের হয়ে কে আসছে”? আমি বললাম – “আরে এখন তো ইউনিয়ন হয়ে গেছে। যে অফিসার পাঠাচ্ছে, তাকেই তারা তাড়াচ্ছে। এখন গৌর কিশোর দাস নামে এক ভদ্রলোক এসেছেন”। দাদু চমকে উঠলেন নামটা শুনে – “সেই গৌর কিশোর? সেই নন-ম্যাট্রিক ছেলেটা, যে টিকিট ক্লার্ক ছিল আমার স্টেশনে”? আমি বললাম – “হ্যাঁ, এক্কেবারে ঠিক ধরেছ, সেই গৌর কিশোর দাসই। তোমার সময়েই তো প্রমোশন পেয়ে গার্ড হয়”। দাদু বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দেওয়ালে সেই ছবিটায় ঠাকুর আর মায়ের পা দু’ হাত দিয়ে ছুঁয়ে বললেন – “ঠাকুর তোমার লীলা বোঝে কার সাধ্য। ওকে অফিসার করে ছাড়লে”? তারপর আমাকে শোনালেন সেই ঘটনা। দাদু চাকরী থেকে অবসর নেন সোনামুখির স্টেশন মাষ্টার হিসেবে। সেই সময়ে গৌর কিশোর দাস কাজে যোগ দেয় সোনামুখি স্টেশনেই – টিকিট ক্লার্ক পদে। সে সব দিনে স্টেশনে কয়েকটা সোনামুখি-হাওড়া ফার্স্ট ক্লাস টিকিট রাখা থাকত ঠাকুর পরিবার এবং কিছু পশ্চিম আর দক্ষিণ ভারতের ভক্তদের জন্যে। সে টিকিটে দাম ছিল ৩ টাকা ৮ আনা (বর্তমান ভাষায় সাড়ে তিন টাকা)। আগের বিবরণে যেমন বলেছি, প্রায় প্রতি সন্ধ্যেতেই ঠাকুর বেড়াতে আসতেন স্টেশনে দাদু এবং অন্যান্যদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে। কাজে যোগ দেবার পর গৌর কিশোরও সহকর্মীদের মুখে শুনে শুনে ঠাকুর সম্বন্ধে কিছু কিছু জানতে শুরু করে।
একদিন ঠাকুরের কোলকাতা যাওয়ার কথা। দাদু গৌর কিশোরকে বলে রাখলেন যে ঠাকুর আসলে ওনাকে একটা ফার্স্ট ক্লাস টিকিট কেটে দিতে। সে করলে কি, আগে ভাগেই টিকিটটা কেটে, পাঞ্চ করে নিজের পকেটে রেখে দিল। ট্রেনের সময়ের কিছু আগে ঠাকুর এলেন। আসতেই গৌর কিশোর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে টিকিটটা ঠাকুরের পায়ে দিল। ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন – “হ্যাঁরে, কত দিতে হবে টিকিটের দাম”? গৌর কিশোর বললে – “কিছু না ঠাকুর। এটা আপনাকে আমার প্রণামি”। ঠাকুর অবাক হয়ে বললেন – “সে কি রে? এত দামী প্রণামি আবার কেউ দেয় নাকি”? গৌর কিশোর হাত জড়ো করে বললে – “ও কিছু নয় ঠাকুর”। ঠাকুর একটু একটু মজা পাচ্ছিলেন বলে মনে হল। দাদুকে তখন জিজ্ঞেস করলেন – হ্যাঁ রে কুলদা, ওর বেতন কত যে এমন দামী একটা প্রণামি দিচ্ছে”? দাদু জানালেন মাসিক ৭ টাকা-৪ আনা মাইনে পায় সে। ঠাকুর গৌর কিশোর কে বললেন – “এত টাকার প্রণামি যে দিলি, তা তোর সংসার চলবে কি করে”? সে বলল – “ও ঠিক চলে যাবে”। ঠাকুর এবার বেশ মজা পাচ্ছেন বোঝা গেল। দাদুর দিকে চেয়ে তখন বললেন – “তোর এই ছেলেটি বাবু বেশ চালাক চতুর। যাক, প্রণামি যখন দিয়েছে, তখন ওকে একটা আশীর্বাদ তো করতেই হয়। কি আশীর্বাদ করি বল দেখি”। আর তারপরই গৌর কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন – “যা, তুই একটা দিনের জন্যে হলেও, রেলের অফিসারের চেয়ারে বসবি”। নন-ম্যাট্রিক, দেশী টিকিট বাবুর এতটা পদোন্নতি সেই সময়ে কারুর কল্পনাতেও আসা সম্ভব্য ছিল না। আর তাই, এত যুগ পরে, অসম্ভবকে সম্ভব করে সেই আশীর্বাদ হাতে হাতে ফলে যেতে দেখেই ছিল দাদুর সেই অভিব্যক্তি – “ঠাকুর তোমার লীলা বোঝে কার সাধ্য”।
ব্লগ পোস্ট # ৩৫; ০৮/০৬/২০১৭ - ’ঠাকুর - আমাদের সব পথের পথনির্দেশক"
ব্লগ পোস্ট # ৩৫; ০৮/০৬/২০১৭ – ‘ঠাকুর – আমাদের সব পথের পথনির্দেশক”
শ্রী গুণময় মুখোপাধ্যায়ের মৌখিক বর্ণনার ভিত্তিতে তিলক ঘোষালের লেখা
আমার মত আমার দাদু (মাতামহ) শ্রী কুলদা রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন রেলের কর্মী। সোনামুখি স্টেশন মাষ্টার হিসেবে অবসর নেন। কুসুমকুমারী মা ছিলেন সম্পর্কে দাদুর সেজ ভাইয়ের স্ত্রীর পিসিমা। অর্থাৎ সেই দিক থেকে ঠাকুর হলেন মায়ের ভাশুর। বহুদিনের পরিচিতি ছাড়াও এই সম্পর্কের বাঁধনে ঠাকুর আর দাদুর বন্ধুত্ব ছিল খুব গভীর। সোনামুখির বাইরে না থাকলে প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে ঠাকুর হাঁটতে হাঁটতে যেতেন স্টেশনে দাদু আর অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে। আর দাদুর মতই তারা সবাইও ওনাকে ঠাকুর বলেই সম্বোধন করতেন। তবে ঠাকুরের পোশাক পরিছহদ ছিল এমনই ধোপ দুরস্ত যে বাইরের কারুর বোঝার উপায় ছিল না উনি আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ না কোন অভিজাত পরিবারে কর্তা।
যখনই নজরে পড়ত ঠাকুর আসছেন স্টেশনের দিকে, পয়েন্টসম্যান নিবারণ একটা চেয়ার বার করে পেতে দিত স্টেশনের লাগোয়া নীম গাছেটার তলায়। দাদু থাকতেন স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ের কোয়ার্টারে। সে সময়ে ব্রুক বন্ড কোম্পানির একটা ডিপো ছিল সোনামুখিতে আর তাদের এজেন্ট একটা ভালো চা পাঠিয়ে দিত দাদুকে প্রতি মাসে। সে চায়ের ফ্লেভার ছিল ঠাকুরের খুব পছন্দের। ঠাকুর এসে বসলেই, দিদিমা সেই চা তৈরি করে কয়েকটা বিস্কুটের সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন দাদুর জন্যে। চায়ের চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে চলতো জমিয়ে আড্ডা আর নানান মস্করা।
সেটা আষাঢ় মাস। বর্ষা নেমে গেছে। হটাতই খবর এলো যে চাষবাষ সংক্রান্ত কোন একটা সমস্যা সমাধানের জন্যে দাদুকে ইছারিয়া (দেশের বাড়ি) যেতে হবে। সেই ব্রিটিশ রাজত্বে রেলের অফিসারদের নির্ধারিত সাপ্তাহিক বিরতিই অনেক সময়ে পাওয়া কঠিন ছিল। কাজেই ২-৩ দিনের ছুটি পাওয়া যে কি দুষ্কর ছিল তা সহজেই অনুমেয়। যাই হো’ক, দাদুর অনেক অনুনয় বিনয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসার বোস বাবু রাজি হন এক শর্তে। তিনি পরের দিন একজন অফিসারকে সোনামুখি পাঠাবেন দুপুরের ট্রেনে। তাঁকে চার্জ বুঝিয়ে দাদু রওনা হতে পারেন। পরের দিন বাড়ির সমস্ত কাজ সেরে দাদুকে তার পরের দিনই সেই অফিসারকে ছেড়ে দিতে হবে যাতে সন্ধ্যের ট্রেন ধরে তিনি নিজের কাজে ফিরে যেতে পারেন। বোস বাবু এও পরিষ্কার করে বলে দিলেন যে কোন রকম অন্যথা হলে দাদুর চাকরী নিয়েই টানাটানি পড়ে যেতে পারে। সে কালে সোনামুখি থেকে ইছারিয়া যাবার একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ি, আর তাতে সময়ও লাগত প্রচুর। তার ওপর আবার বর্ষা কাল – যাতায়াত আরও কঠিন। কিন্তু কিই বা উপায়। দাদু রাজি হলেন।
পরের দিন ঠাকুর বিকেলে যথারীতি স্টেশনে আসছেন। দাদুর কোয়ার্টারের সামনে একটা ছত্রিওয়ালা গরুর গাড়ি দেখে হাঁক দিলেন – “এই কুলদা, গাড়ি কার জন্যে? কে কোথায় যাবেক রে ?”। দাদু বেরিয়ে এসে বললেন – “আর বলনা ঠাকুর, আমিই বেরোচ্ছি। খুব জরুরি কাজে ইছারিয়া যেতে হচ্ছে”। ঠাকুর বললেন – “তা এই ঘন বর্ষায় এত বেলায় বেরোচ্ছিস কেন? এতটা পথ”। দাদু বললেন – “তা কি করবো বল, এই তো এখুনি বদলী অফিসার এসে পৌঁছল। সে না আসা পর্যন্ত তো বেরোতে পারছিলাম না। আর না গেলেই নয়। সে যাক, তুমি বসে গল্প টল্প কর। তোমার চা নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি এগোই”। ঠাকুর খুব চিন্তিত মুখে বললেন – “এগোবি? তা এগো, কি আর করা । কিন্তু পথে কষ্ট আছে রে”।
ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিক যেতেই নামলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। ধীরে ধীরে মাটির দু’ধারে গরুর গাড়ির চাকার লাইন দুটোও আর দেখা যাচ্ছেনা। আমাদের কুল দেবতা সত্যনারায়ণ। দাদু বিড় বিড় করে শুধু “নারায়ণ, নারায়ণ, নারায়ণ” করে চলেছেন। এমন সময় হটাতই দেখেন অল্প দূরে একটা কুকুর এগিয়ে যাচ্ছে। দাদুর কি মনে হল, উনি গাড়ির চালক কে জিজ্ঞেস করলেন -“হ্যাঁ রে, তোর কাছে মুড়ি আছে”? সে জবাব দিল আছে। দাদু বললেন – “এক কাজ কর তো। কুকুরটাকে ডাক আর মুড়ি ছড়াতে ছড়াতে ওর পিছন পিছন চল। ওকে একদম নজর ছাড়া করিস না”। তাই চলল। কুকুরটা মুড়ি দেখে এক বার করে আসে, শোঁকে আর আবার এগিয়ে যায়। গরুর গাড়িও চলছে তার পিছন পিছন।, দাদুর মুখে অবিরত “নারায়ণ, নারায়ণ”। কুকুরের পিছন পিছন এই ভাবে গাড়ি এসে পৌঁছুল পাঁচাল গ্রামে। বৃষ্টি তখন খানিকটা ধেরছে, গরুর গাড়ির চাকার লাইনটাও একটু একটু আবার দেখা গেল। বহু রাত্রে দাদু পৌঁছলেন ইছারিয়ায় বাড়িতে। সকালে চাষের সেই সমস্যার সমাধান করে দিয়ে পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লেন সোনামুখির দিকে, সময় মতো সেই বদলী অফিসারকে রিলিজ করতে। ফেরার পথে আর তেমন সমস্যা না হওয়ায়, দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলেন সোনামুখি।
বিকেলে যথারীতি ঠাকুর স্টেশনে আসার পথে দাদুর কোয়ার্টারে সামনে এসে হাঁক দিলেন – “কি রে কুলদা, ফিরেছিস”? দাদু বেরিয়ে এসে বললেন -“হ্যাঁ ঠাকুর এই ফিরলাম। তবে পথে যা কষ্ট গেছে তা আর কি বলব”। ঠাকুর বললেন – “তোর আবার কি কষ্ট গেল? অতটা পথ ধরে ভিজলাম তো আমি। তুই তো দিব্যি গাড়ির ঝাঁপির নিচে বসে ছিলি”। দাদু খানিক হতভম্ব হয়ে বললেন -“তার মানে? তুমি আবার কোথায় ভিজলে”? ঠাকুর বললেন – “কে তোর সামনে সামনে ভিজতে ভিজতে হেঁটে অতটা পথ পার করালে রে? ওই বেষও ধরতে হল তোর জন্য। তোর নারায়ণ কিছু করলেক”? দাদুর মনের কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে লাগলো – দু’ চোখে তখন জলের ধারা। পায়ে পড়ে বললেন -“ঠাকুর, ক্যর সাধ্য তোমার লীলা বোঝে”। ঠাকুর দাদুকে দু’হাত ধরে তুললেন। তারপর দুই বন্ধুর দৃঢ় আলিঙ্গন !!
ব্লগ পোস্ট # ৩৪; ১৮/০৪/২০১৭ - "অবশেষে সে প্রশ্নের উত্তর”: শ্রীমতী বিষ্ণুপ্রিয়া বিশ্বাস, বর্ধমান
ব্লগ পোস্ট # ৩৪; ১৮/০৪/২০১৭
“অবশেষে সে প্রশ্নের উত্তর” – শ্রীমতী বিষ্ণুপ্রিয়া বিশ্বাস, বর্ধমান
যুগল প্রভু কুসুমহরনাথের নাতবৌ শ্রীমতী ধীরা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার দিদি। স্বভাবতই দিদির বিয়ের পর সোনামুখি গেছি বহুবার, আর তা থেকে গড়ে উঠেছে ঠাকুর আর মায়ের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ। উৎসব, অনুষ্ঠানে খুব বেশী না হ’লেও সময় পেলেই ছুটে যাই সোনামুখি; বাগান আর শ্রী মন্দিরের পরম শান্তির ছায়ায়। তবে ২০১৫ সালের দাদুর স্বার্ধশতবর্ষের উৎসবে গিয়েছিলাম আর যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা অবর্ণনীয়। এখানে সেই সময়ের একটি ছোট্ট ঘটনা ভক্তদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
পাঠকের হয়তো মনে আছে যে সেই উৎসব উপলক্ষে দু’টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তার একটাতে দিদি (ধীরা বন্দ্যোপাধ্যায়) “ঠাকুরের প্রিয় বস্তু” নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন । অনেক অনুসন্ধান করে তৈরি করেছিলেন ঠাকুরের বিশেষ পছন্দের সব ধরনের জিনিষের একটা তালিকা। উৎসবের শেষে একদিন সন্ধেবেলায় দিদির সোনামুখির বাড়িতে (‘স্নেহলতা’) বসে গল্প করছি। এমন সময় বাইরে থেকে কেউ ডাকলেন “ধীরা দেবী বাড়ি আছেন’? দিদিকে সোনামুখিতে পরিচিত কেউই ‘ধীরা দেবী’ বলে ডাকে না। তাই খানিকটা অবাক হয়েই আমরা দু’জন বাইরের বারান্দায় এসে দেখি এক প্রবীণ ভদ্রলোক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে। দিদি নিজের পরিচয় দিতে উনি ভেতরে এসে দুটি কথা বলবার অনুমতি চাইলেন। এসে বসে প্রথেমেই বললেন – “আমার নাম গুণময় মুখোপাধ্যায়। আজ আমি এসেছি শুধু আপনাকে আমার গভীর কৃতজ্ঞতা জানাতে। কারণ আপনার পত্রিকার লেখাটা আমার মনের প্রায় তিরিশ বছরের একটা দ্বন্দ্বের অবসান করেছে”। আমাদের দুজনের হতভম্ব ভাব দেখে হেসে বললেন, – “বুঝিয়ে বলছি”। তারপর যা বললেন তা এই রকমঃ
সে সময়ে উনি ছিলেন সোনামুখি রেল স্টেশনের স্টেশন মাষ্টার। ছোট স্টেশন, গুটি কয়েক আপ আর ডাউন ট্রেন। যাত্রী সংখ্যাও অল্পই। কাজেই স্টেশনে কর্মী সংখ্যার বরাদ্দও তেমনি কম, তার ওপর তাদের কামাই/ছুটির তো অন্ত নেই। কাজেই বেশীর ভাগ দিনই ব্যস্ত থাকতে হত গুণময় বাবুকে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করতে। এমনই ব্যস্ততাপূর্ণ ছিল সেই ৩১ ডিসেম্বর দিনটাও। কাজের চাপে খাওয়াদাওয়া করার সময় পর্যন্ত হয়নি। এই অফিস, এই প্ল্যাটফর্ম, এই সিগন্যাল রুম ছুটে বেড়াচ্ছেন। খিদেতে পেট চোঁচোঁ করছে কিন্তু বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসার সময় পর্যন্ত হচ্ছে না। তারই মধ্যে আবার একটা ট্রেন এসে ঢুকল। এবার টিকিট চেকিংও করতে হবে। সেই কাজে যখন ব্যস্ত, দেখেন ট্রেন থেকে নেমে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। গায়ে সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি, মুখে বরফের মত সাদা গোঁপ আর লম্বা দাড়ি। কাছে এসে টিকিটটা হাতে দিয়ে বললেন – “আপনার খুবই খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে। সামনেই তো হরনাথ ঠাকুরের মন্দির। আজ ওখানে আনন্দ মিলন উৎসব। সবাইয়ের জন্যে আজ ওখানে ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি ওখানেই যাচ্ছি। আপনি যাবেন না”? একে খিদেতে পেটের নাড়ি ভুঁড়ি হজম হবার জোগাড়, তার ওপর এই পরমান্নের আমন্ত্রণ! কিন্তু কাজ ছেড়ে যানই বা কি করে?
কিছু সময় কাটার পরে দেখেন দূর থেকে সেই ভদ্রলোক আবার এগিয়ে আসছেন তাঁরই দিকে। হাতে শাল পাতায় খাবার, ওপরে আরেকটা পাতা দিয়ে ঢাকা। হাতে দিয়ে বললেন – “আপনি তো আসতে পারলেন না। তাই আমিই নিয়ে এলাম। অনেক খিদে পেয়েছে বুঝতেই পারছি। খেয়ে নিন”। এক সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের এমন সহৃদয়তায় একই সঙ্গে বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে তাঁর মুখের দিকে ভালো করে চাইলেন। আর হটাতই একটা অস্পষ্ট ছবি মনে গড়ে উঠতে লাগলো। খাবারটা এক পাশে রেখে মাস্টারমশাই হাত জোড় করে বললেন – “আপনি কে? দয়া করে বলুন আপনি কে আর আমার মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করুন”। কিছু না বলে কাঁধে শুধু একবার হাত রেখে, মৃদু হেসে উনি এগিয়ে গেলেন। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মাষ্টার মশাই, মনে প্রশ্নের ঝড়। একটু দূরে গিয়ে আবার ফিরে এলেন ভদ্রলোক। পকেট থেকে একটা খাম বার করে বললেন – “আর হ্যাঁ, এই নিন পুজোর ফুল’ আর তারপর আবার এগিয়ে গেলেন। মাষ্টারমশাই কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। মনে গড়ে ওঠা সেই আবছা আবছা ছবিটা সব গুলিয়ে দিচ্ছে। খানিক সম্বিত ফিরতে ছুটলেন পিছু পিছু। ভদ্রলোক ততক্ষণে স্টেশন পেরিয়ে লাল মেঠো পথটার দিকে ঘুরছেন। মাষ্টারমশাই যতক্ষণে পৌঁছুলেন, আর দেখতে পেলেন না তাঁকে। ভাবলেন হয়তো সামনের কুঁড়ে ঘরটা আড়াল করছে। সেখানে ছুটে গিয়ে দেখেন সব ভোঁ ভাঁ। সামনে মাঠে একটা প্রাণী নেই। স্তব্ধ আর হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ভগবানকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দেওয়ায়। ধীরে ধীরে পকেট থেকে বার করলেন সেই খামটা যাতে ছিল একটা গোলাপ ফুল। আবার সন্দেহ। গোলাপ ফুল তো ভগবানের পুজোয় ব্যবহার হয় না! তা হ’লে?
সেই থেকে এই স্বার্ধশতবর্ষ অনুষ্ঠান অবধি দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর দুলেছেন মনের ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ এর এই আলো আঁধারিতে। আজ শ্রীমতী ধীরা বন্দ্যোপাধ্যায়র লেখা “ঠাকুরের প্রিয় বস্তু’ প্রবন্ধ করেছে সেই সন্দেহের অবসান। তাতে লেখা ছিল – “ঠাকুরের প্রিয় ফুল – গোলাপ” !!
ব্লগ পোস্ট # ৩৩; ১২/০৪/২০১৭ - "বিপত্তারন ও শিক্ষাগুরু ঠাকুর”ঃ শ্রীমতী চন্দনকণা ঘোষাল; কোলকাতা
ব্লগ পোস্ট # ৩৩; ১২/০৪/২০১৭
“বিপত্তারন ও শিক্ষাগুরু ঠাকুর”: শ্রীমতী চন্দনকণা ঘোষাল; কোলকাতা
আমি যুগল ঠাকুর কুসুমহরনাথের পুত্র কৃষ্ণদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা এবং ঠাকুরের পরম ভক্ত শ্রী শিশির কুমার ঘোষালের পুত্রবধূ । দু’ বছর হল আমার স্বামী শ্রী সনৎ কুমার ঘোষাল কুসুমহরনাথের শ্রী চরণে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে আমার জীবনে দেখা এবং শোনা ঠাকুরের লীলার দু’টি ধারার উল্লেখ করতে চাই – একটি তাঁদের বিপত্তারন রূপ, অন্যটি শিক্ষা গুরুর রূপ।
রক্ষাকর্তা দাদু – ওনার জীবনের ২ টি ঘটনা
প্রথম ঘটনাটা আমাদের বিয়ের কিছুদিন আগের, যেটা উনি একটা চিঠিতে সবিস্তারে লিখে জানিয়েছিলেন ওনার হবু শ্বশুর মশাইকে (আমার বাবা)। ঘটনাটা হ’ল এইরকম। সে সময়ে উনি গৌহাটিতে পোস্টেড ছিলেন। একদিন অফিসের কাজে ব্রহ্মপুত্র নদীর অন্য পারে একটা চা বাগান পরিদর্শনে যেতে হ’ল। দু’দিন পর কাজ সেরে ফিরছেন নৌকোতে করে। হটাতই মাঝ নদীতে নৌকোটা একেবারে উল্টে গেল । জিনিসপত্র যা ছিল সে সব তো গেলই, জলে পড়ে ওনার গায়ের জামাটাও ভেসে গেল স্রোতের ভয়ঙ্কর টানে। উনি আপ্রাণ সাঁতার কেটে চলেছেন পাড়ের দিক লক্ষ্য করে। কিন্তু তা এত দূর আর স্রোত এমনই প্রবল যে এগোতে পারছেন খুবই কম। বহুক্ষণ সাঁতার কাটার পর শেষে অবস্রান্ত হয়ে পড়লেন। হাত, পা সব শিথিল হয়ে এলো। পাড় তখনও আরও খানি দূরে। এমন অবস্থায় যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, হটাতই কে যেন পিছন থেকে ঠেলে ঠেলে বাকি পথটুকু পার করে ওনাকে পৌঁছে দিল পাড়ে! কে পার করে দিল সেই হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষটাকে?
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটা আমার বিয়ের কিছু পরে। তখন আমরা আসামের রঙ্গিয়াতে থাকি। ইন্সপেকশনের কাজে ওনাকে ট্যুর করতে হত প্রচুর। একদিন সেই কাজেই বেরিয়েছেন ট্রেনে করে অন্য এক শহরের দিকে। কিন্তু কি যে হ’ল কে জানে, নির্দিষ্ট স্টেশন মনে করে মাল পত্র নিয়ে নেমে পড়লেন গন্তব্যস্থলের ঠিক আগের স্টেশনে। অন্য ব্যাবস্থা করে নির্দিষ্ট শহরে পৌছনোর পর জানতে পারা গেল যে উনি নেমে যাওয়ার পর কিছুদূর গিয়েই সেই ট্রেনটাই এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় পড়ে – বহু লোক হতাহত হয়। কেন অনির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে পড়লেন হটাত?
শিক্ষাগুরু দাদু
এই ঘটনাটা আমার শাশুড়ি মায়ের মুখে শোনা। দাদু এসেছেন কোলকাতায়। কোন এক ভক্তের বাড়িতে উঠেছেন (কার বাড়ি শুনেছিলাম এখন ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না)। আমার শ্বশুরমশাই তো সেখানে রোজ ছুটতেন দাদু আর ভক্ত সঙ্গ করতে। একদিন দাদু ওনাকে বললেন – “বাবা, কাল তোমার বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে আসবো”। শ্বশুর মশাই তো শুনে আহ্লাদে আটখানা। তড়িঘড়ি করে ছুটলেন বাড়িতে খবরটা দিতে। সেখানে তো একেবারে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। পরদিন সক্কাল সক্কাল শ্বশুরমশাই নিজেই বাজার করে আনলেন যতরকমের শাক, সবজি বাজারে ছিল আর এসেই পরিষ্কার নির্দেশ সমস্ত কিছু রাঁধতে হ’বে, কিচ্ছু বাদ দেওয়া চলবে না। আমার জেঠ শাশুড়ি আর মাও লেগে পড়লেন রান্নার কাজে। যথা সময়ে দাদু কিছু ভক্তদের নিয়ে পৌঁছে গেলেন ভবানীপুরে বকুল বাগানের বাড়িতে। অল্প জলখাবার খেতে খেতে চলল জমিয়ে ‘আড্ডা’। খানিক পরে রান্নাবান্নাও তৈরি। দাদু তখন ভক্তদের নিয়ে গঙ্গা স্নানে গেলেন (ভবানিপুরের বাড়ির অনতিদূরেই গঙ্গার ঘাট)। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। দাদুর ফেরার সময় হয়ে গেছে, অথছ আসছেন না। এমন সময় হটাতই এক গরিব ব্রাহ্মণ বাড়ির দুয়োরে এসে বললে – “আমাকে কিছু খেতে দেবে, মা”? সবাই একটু অপ্রস্তুত এই ভেবে যে দাদুর জন্যে রান্না হয়েছে – ওনাকে পরিবেশন করার আগে তা অন্য কাউকে কি করে দেওয়া যায়। অতিথিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে শ্বশুরমশাই শুধু ঘর বার করে চলেছেন। কিন্তু দাদুর দেখা নেই। এদিকে অভুক্ত অতিথিকেই বা কতক্ষণ অপেক্ষা করানো যায়? শেষে উনি শাশুড়ি মাকে বললেন অতিথিকে পরিবেশন করতে। অতিথিও খাওয়া শুরু করেছেন আর দাদুও বাড়ি পৌঁছুলেন ভক্তদের নিয়ে হই হই করতে করতে আর বললেন – “মা, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে”। তারপর খেতে বসে শাক থেকে আরম্ভ করে সব ক’টি পদ খেলেন পরম তৃপ্তির সঙ্গে, রান্নার পঞ্চমুখ প্রশংসা করতে করতে। এই ভাবে ‘আপনি আচরি’ সবাইকে আবার করে বুঝিয়ে দিলেন দরিদ্র নারায়ণ সেবার মাহাত্ম। যা সচক্ষে দেখেছি ঠাকুমাকে (কুসুম কুমারী মা) করতে। আনন্দ মিলন উৎসবে যতক্ষণ না দরিদ্র নারায়ণ সেবা শেষ হচ্ছে, ঠাকুমা খেতে বসতেন না। সবার খাওয়া হ’লে কোন একটা উচ্ছিষ্ট পাতা থেকে আগে এক কণা ‘প্রসাদ’ তুলে আগে মুখে দিয়ে তারপর বসতেন খেতে।
ব্লগ পোস্ট # ৩২; ২৯/০৩/২০১৭ - “সোনামুখি শ্রীমন্দিরের যুগল মূর্তি ও মা কেমন মনের দ্বন্দ্ব ঘোচান”: শ্রীমতী এ.জয়লক্ষ্মী; হায়দ্রাবাদ
“সোনামুখি শ্রীমন্দিরের যুগল মূর্তি ও মা কেমন মনের দ্বন্দ্ব ঘোচান”: শ্রীমতী এ.জয়লক্ষ্মী; হায়দ্রাবাদ
(শ্রীমতী জয়লক্ষ্মীর মৌখিক বিবৃতির ভিত্তিতে শ্রী হরগপাল সেপুরির লেখা)
(বাংলা অনুবাদ: তিলক ঘোষাল)
সোনামুখি শ্রীমন্দিরের যুগল মূর্তি:
সোনামুখি শ্রীমন্দিরের বাবা মায়ের যুগলমূর্তি যে কেমন জাগ্রত তা বিশেষ ভাবে অনুভব করতে পারি ২০০৩ সালের একটি অদ্ভুত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। সে বছর দুর্গাপুজোর সময়ের নাম সপ্তাহমে যোগ দিতে সোনামুখি গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল নন্দুরী পরিবারের ভেঙ্কটেশ্বর রাও, কুসুমাম্বা, সম্পথকুমার, রমণী এবং ইন্দিরা নন্দুরীর ছোট ছেলে চৈতন্য। সপ্তাহাম আরম্ভ হ’বার পাঁচ দিন আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম আর সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের ক’জনের সৎসঙ। এক সন্ধ্যে বেলায় আমি মা কুসুম কুমারীর মূর্তির বাঁদিকের জানালার ধাপিটার ওপর বসে নামজপ করছি। হটাতই খানিক পরে অনুভব করলাম আমার গায়ে পিঁপড়ের কামড়। চোখ খুলে গা ঝাড়তে উঠে দেখি একটা পিঁপড়ে নেই গায়ে। পিঁপড়ের কামড়ের সেই অনুভূতিও উধাও। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। যাই হোক, খানিক পরে বাবার মূর্তির কাছে গিয়ে বসলাম। তখনই চোখে পড়ল বাবার ধুতি আর জামা পিঁপড়ে ভর্তি। মনে হল যেন বাবার সারা গায়ে পিঁপড়ের কামড় ! হতভম্ব হয়ে গিয়ে ডাকলাম কুসুমাম্বাকে। সে তখন মায়ের মূর্তির কাছে বসে চোখ বুঝে নাম জপ করছে। আমার ডাক শুনে হুড়মুড় করে ছুটে এলো। তাকে দেখালাম বাবার সারা গায়ে ঘুরে বেড়ানো অজস্র পিঁপড়ে আর বললাম খানিক আগেই কেমন আমার গায়ে একটা পিঁপড়েও না থাকা সত্ত্বেও সেই কামড়ানোর অদ্ভুত অনুভূতির কথা। দু’জনেই অবাক হয়ে রইলাম! এর কি কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্ভব?
মা কেমন মনের দ্বন্দ্ব ঘোচান:
আমার স্বামী তখন খুবই অসুস্থ। আমি যথারীতি তাঁর সেবা শুশ্রূষা করে চলেছি। ভাবতাম এ কাজ আমাকে ঠাকুর দিয়েছেন এবং আমি তা করছি তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী। অবশ্য এও বুঝতাম যে স্ত্রী হিসেবেও এটা আমার একটা পবিত্র দায়িত্ব। কিন্তু তাও মনে খচখচ করতো একটা জিনিষ। আর তা হল যে এই কাজের জন্যে হয়তো বা আমার ঠাকুরের সেবায় কিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর সে চিন্তাটা আমাকে বেশ পীড়া দিত। তারপর এক রাত্রে স্বপ্নে মা কুসুমকুমারীকে দেখলাম। উনি আমায় বললেন আমি দুটো সেবাই যথাযথ ভাবে করছি, এর বেশী আমাকে আর কিছুই করতে হবে না। এই বলে কাছে টেনে নিয়ে আমার কপালে স্নেহচুম্বন করলেন। তারপর উনি শুয়ে পড়লেন আর আমি ওনার পা টিপতে লাগলাম। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখলাম মনের সমস্ত দ্বন্দ্ব দূর হয়ে সম্পূর্ণ স্বস্তি অনুভব করছি। ………………………যদিও স্বপ্নে বাবার দর্শনের সৌভাগ্য আমার হয় নি, কিন্তু ওনার উপস্থিতি অনুভব করি কখনো কখনো – একটা আলোর আভার মত। সে সময় চারদিকটা ভরে যায় এক অপূর্ব সুগন্ধেও।
ব্লগ পোস্ট # ৩১; ১৭/০৩/২০১৭ - "চির সজাগ শুনতে মনের কথা": শ্রীমতী এ.জয়লক্ষ্মী; হায়দ্রাবাদ
“চির সজাগ শুনতে মনের কথা“
নীচের ঘটনা দু’টি শ্রীমতী জয়লক্ষ্মীর মৌখিক বিবৃতির ভিত্তিতে শ্রী হরগপাল সেপুরির লেখা
(বাংলা অনুবাদ: তিলক ঘোষাল)
ভাবি কে ছিলেন তিনি
আমাদের হায়দ্রাবাদ বাড়ির বাগানে অনেকগুলো জবা ফুলের গাছ ছিল আর তাতে প্রচুর ফুল ফুটত। আর যখনই যেতাম শহরের কুসুমহরনাথ মন্দিরে, গুচ্ছের সে ফুল নিয়ে যেতাম বাবা আর মায়ের জন্যে। সে সময়ে সত্যবতাম্মা থাকতেন মন্দির প্রাঙ্গণেই একটা ঘরে। সেখানে পৌঁছে সব ফুলগুলো দিতাম ওনার হাতে। সেগুলো উনি আলাদা করে রেখে দিতেন, আর সঙ্কীর্তন শেষ হবার পর সব কটা ছড়িয়ে দিতেন তাঁদের মূর্তির ওপর। এখানে যে ঘটনাটির বিবরণ দিচ্ছি সে’টা সম্ভবত ১৯৮০ সালের কথা । সে’দিন মা কুসুমকুমারীর শুভ জন্মদিন। মন্দিরে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে গেলাম বাগানে জবা ফুল তুলতে, কিন্তু সে’দিন পেলাম মাত্র গোটা ৪/৫ ফুলই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কি আর করা যাবে ভেবে যা পেলাম তাই নিয়েই গেলাম মন্দিরে আর অন্যান্য দিনের মতই সে’গুলো তুলে দিলাম সত্যবতাম্মার হাতে। খানিক পরে দেখি আরেক ভক্ত এক ঝুড়ি সুন্দর গোলাপ নিয়ে এসেছেন ঠাকুরের জন্যে। মনে মনে ক্ষোভ উগরে উঠলো আর ঠাকুরকে বললাম – “ওহ, এই ফুল পাবে বলেই আমাকে মাত্র ঐ ক’টা দিলে”। মনের কথা শেষ হওয়া মাত্র দেখি সত্যবতাম্মা আমার আনা ফুলগুলো বাবা আর মায়ের মূর্তির পায়ে রাখলেন আর তারপর আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বললেন – “কি, এ’বার খুশি তো?” কিন্তু সেই হাসি আর ওনার মুখের ভাবে এমন একটা কিছু ছিল যা মনে জাগালো এক অদম্য কৌতূহল। আমি তক্ষুনি উঠে পিছু পিছু ওনার ঘরের দিকে গেলাম ব্যাপারটা কি বুঝতে। কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখি সত্যবতাম্মা সেখানে নেই। যারা ছিল ঘরে তাদের জিজ্ঞেস করে জানলাম উনি কিছু আগে বাথরুমে গেছেন, এখনও ফেরেন নি। আমি হতবাক হয়ে গেলাম! তবে কে ছিলেন তিনি, যিনি কয়েক মুহূর্ত আগেই মূর্তির পায়ে আমার আনা ফুলগুলো বিছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন – “কি, এ’বার খুশি তো?”…….
সন্দেহের অবসান
সেপুরি আম্মার (শ্রীমতী আল্লুরাম্মা) উপদেশ অনুসারে আমি হরনাথের সেবা করতাম একটা ছবিতে আর অনুভব করতাম তার প্রতি এক মাতৃসুলভ আকর্ষণ (বাৎসল্য ভাব) । তাকে দেখতাম নিজের সন্তানের মত। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে সব সময়ে খোঁচা মারত – আমার এই ভালবাসা কি এক তরফা না কি সেও ঠিক একই রকম ভালবাসে আমাকে নিজের মায়ের মতো। আমার স্থির ধারনা ছিল এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন একমাত্র সেপুরি আম্মাই, কারণ তিনিই মাঝে মধ্যে শুনতে পেতেন ঠাকুরের কণ্ঠস্বর । সে সময়ে আম্মা ছিলেন তিরুপতিতে, ওনার মেয়ে ডা. ভরলক্ষ্মীর বাড়িতে। কপাল গুনে আমার সেই অস্থির মনের অবস্থায় হটাতই একদিন ডা. ভরলক্ষ্মী হায়দ্রাবাদ আমাদের বাড়িতে এলেন দেখা করতে। স্বভাবতই আমার মনের সেই প্রশ্ন আর তার উত্তর যে আম্মার কাছেই পাওয়া যাবে সে বিশ্বাসের কথা তাকে খুলে বললাম। তবে এও বললাম যে সে যেন ফিরে গিয়ে আম্মাকে এ’সব কথা না বলে, কিন্তু উনি যদি নিজের থেকে আমাকে কিছু জানাতে চান তা যেন সে আমাকে তৎক্ষণাৎ জানায়।……….তিরুপতিতে নিজের বাড়িতে ফেরার কয়েক দিন পরে হটাতই সেপুরী আম্মা একদিন মেয়েকে (ডা. ভরলক্ষ্মী) বললেন যে ঠাকুর তাঁকে বলেছেন যে জয়লক্ষ্মী (অর্থাৎ আমি) বাৎসল্য ভাব নিয়ে তাঁর সেবা করি, তাকে নিজের পুত্রসম ভালবাসি। ভরলক্ষ্মীও আমাকে তক্ষুনি এ খবরটা দিল। সব দ্বন্দ্ব দূর হয়ে মন ভরে গেল অকল্পনীয় আনন্দে।
পোস্ট # ৩০; ২৩/০২/২০১৭ - “ঠাকুরের অসীম কৃপার এক নিদর্শন”: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভক্ত
“ঠাকুরের অসীম কৃপার এক নিদর্শন”: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভক্ত
(সেই ভক্তের মৌখিক বিবৃতির ভিত্তিতে শ্রী হরগপাল সেপুরির ইংরিজিতে লেখা)
(বাংলা অনুবাদ তিলক ঘোষাল)
আমি ভারতীয় রেলওয়েতে ইঞ্জিন ড্রাইভারের চাকরী করি। হরনাথ সমাজে আমার প্রবেশ তুলনামূলক ভাবে বেশ সম্প্রতি, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু গোড়া থেকেই এমন অদম্য আকর্ষণ অনুভব করতাম ঠাকুরের প্রতি যে কোলকাতা বা কাছাকাছি কোথাও ঠাকুরের নাম সঙ্কীর্তন হলেই ছুটতাম সেখানে। এমনই এক নাম গানের অনুষ্ঠান ধার্য হয়েছিল সেই বছরেরই ৮ই অগাস্ট, বাগবাজার হরনাথ স্কুলে। কিন্তু সেই সময়ে রেলওয়েতে চলছিল চলছিল ইঞ্জিন ড্রাইভারের এক সাময়িক ঘাটতি। কাজেই সেই নাম সঙ্কীর্তনে যোগ দিতে ছুটি পাওয়া ছিল অসম্ভব। কিন্তু মন তা মানতে নারাজ।
৬ তারিখ, অর্থাৎ অনুষ্ঠানের ঠিক দু’দিন আগে আমাকে দায়িত্ব ছিল একটা লোকাল ট্রেনকে হাওড়া স্টেশন থেকে চন্দনপুর নিয়ে যাওয়া। হাওড়া স্টেশন থেকে গাড়িটা বার করে প্রথম সবুজ সিগনালটাও পেরিয়ে গেলাম ঠিক ভাবেই। কিন্তু খানিক পরে আমার কি হল জানি না যে দ্বিতীয় সিগনালে লাল বাতি থাকা সত্ত্বেও আমি না থেমে ট্রেন এগিয়ে নিয়ে চললাম। বুঝতেই পারছেন এটা কত বড় বিপজ্জনক আর বেআইনি কাজ। এতে চাকরী চলে যাওয়া একরকম নিশ্চিত। লিলুয়া স্টেশন ট্রেনটা থামতেই স্টেশন মাষ্টার ছুটে এলেন আমার কাছে আর জানালেন যে আমার ভয়ঙ্কর ভুলটা ক্যাবিন রুমে ইতিমধ্যেই নথিবদ্ধ হয়েছে। ট্রেন ডানকুনি স্টেশনে পৌছতেই আমার সঙ্গে এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর দেওয়া হল গন্তব্য স্টেশন পর্যন্ত আমার কাজের তদারকির জন্য। চন্দনপুর স্টেশনে নামতেই জানানো হল আমাকে তক্ষুনি হাওড়া স্টেশনে রিপোর্ট করতে হবে। হাওড়ায় আমার সমস্ত বক্তব্য লেখা হল এবং তৎক্ষণাৎ একটা তদন্তও শুরু হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে এলাম। পরের দিন কোন ডিউটির জন্যে আমাকে ডাকা হল না। ৮ তারিখে (নাম গানের দিন) আমি আমার ঊর্ধ্বতন সিনিয়র ক্রু কন্ট্রোলারকে জিজ্ঞেস করলাম আমি বাগবাজারের সেই অনুষ্ঠানে যেতে পারি কি না। উনি সম্মতি দিয়ে বললেন মোবাইল ফোনটা সঙ্গে রাখতে, যাতে কোন রকম ডিউটি নির্ধারিত হলে তক্ষুনি আমাকে খবর দিতে পারেন। লঞ্চে গঙ্গা পার হয়ে বাড়ি থেকে বাগবাজার যেতে লাগবে আধ ঘণ্টা মত। আবার ডাক পড়লে কাজে পৌঁছুতেও লাগবে তেমনই অল্প সময়। ঠাকুর আমার মনস্কামনা পূর্ণ করলেন আর আমি যোগ দিতে পারলাম হরনাথ স্কুলের সেই আনন্দময় নাম সঙ্কীর্তনে।
এখানেই শেষ নয় ঠাকুরের কৃপার। রক্ষা করলেন সিগন্যাল ভাঙ্গার মত সেই গুরুতর অপরাধের শাস্তি থেকেও। কোন চার্জ শিট ফাইল না, শুধু মাস খানেক আমাকে ডিউটি দেওয়া হল না, এই মাত্র। সে মাসের বেতনও কাটা পড়ল না। এর পর আগের মতনই পেতে আরম্ভ করলাম নিয়মিত ডিউটির ডাকও। আজ অবধি ভেবে পাইনা এই অবিশ্বাস্য সমস্ত কিছু ঘটলো কি ভাবে! আমাকে তাঁর গোষ্ঠীতে প্রবেশের অনুমতি দেবার পর পরই ঠাকুর আমাকে আস্বাদন করালেন তাঁর অসীম কৃপার এক কণিকা মাত্র।
পোস্ট # ২৯; ১৫/০২/২০১৭ - “আমার একাকীত্বের সময়ে ঠাকুরের সাহায্যের হাত”: শ্রীমতী এ.জয়লক্ষ্মী; হায়দ্রাবাদ
“আমার একাকীত্বের সময়ে ঠাকুরের সাহায্যের হাত”: শ্রীমতী এ.জয়লক্ষ্মী; হায়দ্রাবাদ
(শ্রীমতী জয়লক্ষ্মীর মৌখিক বিবৃতির ভিত্তিতে শ্রী হরগপাল সেপুরির লেখা)
(বাংলা অনুবাদ: তিলক ঘোষাল)
তিরুপতির ডাক্তার শ্রীমতী বরলক্ষ্মী আর আমি গুণ্টুর শহরে একই ক্লাসে পড়তাম। তাদের ছিল একনিষ্ঠ হরনাথ ভক্তের এক পরিবার। সেই সূত্রে আমিও জানতে পারি ঠাকুর হরনাথের কথা। অবশ্য এর আগে আমার মা কুসুমকুমারীর দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল যখন ১৯৩৭ সালে তিনি একবার মাদ্রাস আসেন। ডাঃ বরলক্ষ্মীর বাবা (সেপুরি লক্ষ্মীনরসৈয়া) এবং মা (সেপুরি আল্লুরাম্মা) আমাকে একেবারে নিজেদের মেয়ের মতন স্নেহ করতেন। এমনকি আজও তাঁদের সন্তানেরা আমাকে তাদের বড় বোনের মতই দেখে ও শ্রদ্ধা করে। তাঁদের সকলের আমার প্রতি এত স্নেহ ভালবাসার কারণ কি তা ঠিক তখন বুঝতাম না। যাই হোক, ১৯৪৪ সালে কলেজের ছুটিতে আমি ডাঃ বরলক্ষ্মীর সঙ্গে কলহস্তি শহরে তাদের বাড়িতে যাই। সে সময়ে ওর বাবা (সেপুরি লক্ষ্মীনরসৈয়া) চাকরী করতেন সেখানের স্কুলের ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবে। একদিন ডাঃ বরলক্ষ্মীর কাছে ঠাকুর হরনাথের একটা লকেট দেখে মনে হল আহা যদি একটা এমন আমার কাছেও থাকত। এ ছাড়াও খুব ইচ্ছে ছিল একটা জপের মালারও। আর আচমকাই একদিন ছোট ভাই তুল্য হরগোপাল আমাকে এনে দিল একটা ছোট্ট জপমালা। সেটা এখনও আমার কাছে আছে। তখন হরগোপালের বয়সই বা কত – বছর দশেক হবে !
সেপুরি পরিবারের সঙ্গে ক’দিন কাটিয়ে, রওনা হ’লাম আমার নিজের বাবা মায়ের বাড়ি এরোডে পথে । তিরুপতি রেল স্টেশনে বসে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। এমন সময় হটাতই দেখি একটা ছোট ছেলে ঠাকুরের লকেট বিক্রি করছে। সাধারণ জিনিসপত্রের মত ঠাকুরের লকেট সাধারণত রেল স্টেশনে বিক্রি হওয়ার কথা নয়। ঝটপট করে কিনে নিলাম একটা। হাতে লকেট নিয়ে এতই বিভোর হয়ে ছিলাম যে কখন যে আমার পার্সটা চলে গেছে তা বুঝতেই পারিনি। আমায় আবার কাটপদী স্টেশন ট্রেন পালটাতে হবে এরোড পৌছুতে। সেই ট্রেনের টিকিট ও ছিল সেই পার্সেই। টাকাকড়িও সব গেছে। তাই কাটপদী স্টেশনে পৌঁছে হতভম্বের মত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় নজরে পড়ে এক ভদ্রলোক লম্বা আরে’ক জনের সঙ্গে কথা বার্তা বলছেন। তাদেরই কথোপকথনের সূত্র ধরে বুঝতে পারলাম সেই ভদ্রলোকের নাম সত্যম। আর কথাবার্তার মধ্যে হটাতই তিনি আমার কাকা এতিরাজালু নাইডুর নাম করে কিছু বললেন অন্যজনকে। অন্য ভদ্রলোকটি চলে যাবার পর আমি আমার কাকার নাম বলে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি তাঁকে চেনেন কি না। তিনি জানালেন তিনি খুব ভালো ভাবে পরিচিত আমার কাকার সঙ্গে। তারপর আমার বিপদের কথা শুনে কোন রকম চিন্তা করতে বারন করে আমাকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে কেটে আনলেন একটা টিকিট। আমি ওনার কাছে পথ খরচা বাবদ পাঁচ টাকা ধারও করলাম। বাড়ি পৌঁছেই ওনাকে মানী অর্ডার করে সেটা ফেরত দেব বলে ওনার ঠিকানাটাও লিখে নিলাম। লকেট পাওয়া আর এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে অনুভূতি এলো আমার একাকীত্বের সময়ে আমার ঠাকুরের সঙ্গ।
বাড়ি এসে শ্রী সত্যমকে মানী অর্ডার করে টাকাটা পাঠালাম। যথা সময়ে তার রশিদও ঘুরে এলো। কিন্তু প্রাপকের সইটা মোটেই পড়া যাচ্ছিল না। এর কিছুদিন পরে আমার কাকা শ্রী এতিরাজালু নাইডুর সঙ্গে দেখা হয়। ওনাকে আমি ওনার পরিচিত সত্যমের কথা বলি। কিন্তু আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম যখন কাকা বললেন সত্যম নামের কাউকেই তিনি চেনেন না ! তিনি একেবারে নিশ্চিত। তবে কে এসেছিলেন ওনার বন্ধুর বেশ ধরে আমাকে সেই একাকীত্বের সময়ে সান্ত্বনা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে? আমার ঠাকুর ছাড়া আর কে হ’তে পারেন তিনি !
(এ ঘটনার সময়ে শ্রীমতী জয়লক্ষ্মী ছিলেন ১৮ বছরের এক তরুণী। এই ২০১৬ সালে ৯০ বছর বয়েসে তিনি আমাদের শোনালেন এই অদ্ভুত লীলা)
ব্লগ পোস্ট # ২৮; ২১/০১/২০১৭ - “বিপদ তারণ কুসুমহর”: ধীরা বন্দ্যোপাধ্যায়; সোনামুখি
“বিপদ তারণ কুসুমহর”: ধীরা বন্দ্যোপাধ্যায়; সোনামুখি
(লেখিকা ঠাকুর ও মায়ের নাত বউ)
১৯৬৫ সালের কথা। আমরা বোম্বাই বেড়াতে গেছি। আমার ছেলের বয়স তখন ৪/৫ বছর। সে’খানে কয়েকদিন কাটিয়ে গেলাম পুনে আর উঠলাম ঠাকুর আর মায়ের পরম ভক্ত শ্রী বি. ডি. ভোরার বাড়িতে। ক’দিন পর সকলে মিলে মহাবালেস্বর যাবার পরিকল্পনা হল। সকলেরই খুব উৎসাহ, কিন্তু কেন জানি না আমার মন কিছুতেই এতে সায় দিচ্ছিল না। তখন কি জানি খুব শীঘ্রই হবে সে রহস্যের উদ্ঘাটন? মহাবালেস্বর রওনা হবার ঠিক আগের দিন বিকেলই শুরু হ’ল ছেলের গলায় ভয়ঙ্কর ব্যথা। কাছের এক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারকে ডাকা হল। তিনি সব দেখে শুনে মত দিলেন ইনফেকশন হয়েছে। কিছু ওষুধ দিয়ে বললেন সেগুলো খাওয়ালেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কোন উপকার তো হ’লই হল না, উল্টে ছেলের অবস্থা দ্রুত বিগড়োতে লাগলো। শুরু হল ভয়ানক শ্বাসকষ্ট আর তার সঙ্গে পেট ফেঁপে ওঠা। তার সেই যন্ত্রণায় ছটফটানি চোখে দেখা যায় না। আমি অঝোরে কেঁদে চলেছি আর প্রাণপণে ডাকছি দাদু আর মাকে। বাড়িতে অন্যদের মুখের ভাবেও বোঝা যাচ্ছে সকলেই সেই একই আর্জি জানিয়ে চলেছে।
ভোরের আলো যে সময়ে প্রায় ফোটে ফোটে, তখন বাড়ির খানিক দূরের জাহাঙ্গীর নার্সিং হোমের ডাক্তারকে ফোন করায় তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন স্কুটার চালিয়ে। ছেলের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন আর তাঁর মুখ থেকে বেরোল একটাই কথা – ‘জলদি, জলদি, অনেক দেরী হয়ে গেছে’। আমি তখন এক হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে। সেই সহৃদয় ডাক্তার শ্রী ভোরার গাড়িতে আসতে বলে, আমাকে বললেন ছেলেকে কোলে নিয়ে স্কুটারের পিছনের সীটে বসতে আর তীব্র গতিতে স্কুটার ছোটালেন নার্সিং হোমের দিকে। সেখানে পৌঁছে প্রথমেই ছেলেকে দিলেন দুটো ইনজেকশন। ততক্ষণে বাড়ির লোকজনেরাও পৌঁছে গেছেন সেখানে। সকলকে উনি ভীষণ গম্ভীর মুখে জানালেন এ’টা আক্যুট ডিপথেরিয়ার কেস এবং অবিলম্বে অপারেশন করা না হলে রোগীকে বাঁচান অসম্ভব। তার সঙ্গে দিলেন এই দুঃসংবাদও যে শহরের কোন হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে ডিপথেরিয়ার চিকিৎসা নিষিদ্ধ এবং সেই কারণে রোগীকে তৎক্ষণাৎ নিয়ে যেতে হবে শহরের বাইরে বেশ দূরের এক নির্ধারিত হাসপাতালে। কি করে একই সঙ্গে দুটোই সম্ভব – যেতেও হবে এতদূরে অথছ দেরী করাও চলবে না। আমার মাথা তখন আর কাজ করছে না। ছেলে কোলে এক ঘোরের মধ্যে আমিও সকলের পিছু পিছু চললাম চললাম গাড়ির দিকে। বিপত্তির অন্ত এখানেই নয়। গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখা গেল ড্রাইভারক আসে পাশে কোথাও নেই। সবাই তাকে খোঁজাখুঁজি করছে আর আমি দেখছি চোখের সামনে কেমন অমূল্য সময় হুহু করে বয়ে যাচ্ছে। এমন সময় হটাতই দেখি সাদা কোট পরা অনেক লোক গেটের দিক থেকে এগিয়ে আসছেন। শুনতে পেলাম কেউ বলছে যে সে’দিন মহারাষ্ট্রের কিছু খ্যাতনামা ডাক্তারদের একটা কনফারেন্স হবার কথা ছিল অন্য এক যায়গায়, কিন্তু কোন অসুবিধের কারণে শেষ মুহূর্তে গতকাল বিকেলেই ঠিক হয়েছে তা হবে এই নার্সিং হোমেই ! তারপর সেই সাদা কোটপরাদের মধ্যে থেকে এক মাঝ বয়েসি ডাক্তার আমাকে দেখে হটাতই এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন ভাবে বললেন – “কি ব্যাপার; কি হয়েছে আপনার ছেলের?” কোন কথা মত অবস্থা না থাকায়, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে অসহায়ের মত চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। নার্সিং হোমের ডাক্তারের মুখে সংক্ষেপে সব শুনে ছেলের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই তাঁদের বললেন – “রোগীর অবস্থা সংকটজনক। সময় নেই, এখুনি অপারেশন থিয়েটার রেডি করুন” – আর এই বলে, নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে ছেলেকে হুড়মুড় করে ঢুকিয়ে দিলেন অপারেশন থিয়েটারে। তৎক্ষণাৎ অনুভব করলাম দাদু আর মা আর এক লীলা কাজ করছে। সমস্ত উৎকণ্ঠা নিমেষে উবে গিয়ে মনটা ভরে গেল এক পরম পরম প্রশান্তিতে। অপারেশন হয়ে গেল নির্বিঘ্নে; আমার ছেলে পেল এক নতুন জীবন !
কিন্তু কি ভাবে সম্ভব হ’ল এমন অসম্ভব……সেই সহৃদয় ডাক্তারের স্কুটার ছুটিয়ে ছেলেকে সেই অত্যন্ত জরুরি প্রাথমিক ইনজেকশন দু’টো দেওয়া…….শেষ মুহূর্তে কনফারেন্সের এই নার্সিং হোমে সেই দিনই স্থির হওয়া…….সেই অচেনা সার্জেনের নিয়ম কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে এখানেই তার জরুরি অপারেশন করা?……কে ঘটালো এমন সব জাদু, একের পর এক?……আবার নতুন করে দেখলাম কেমন শরণাগত, আর্তের কান্নায় কিছুতেই স্থির থাকতে পারেন না আমার দয়াময় দাদু আর দয়াময়ী মা।…… আর অপারেশনের পর যখন ডাক্তার অভয় দিয়ে বললেন – “কোন ভয় নেই, আমরা তো আছি’ – তখন যেন তিনিই মনে করিয়ে দিলেন তাঁর সেই বরাভয় – “আমি রে তোদের কাছে নিতি আছি পাছে পাছে.” ! ……. এই সমস্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শ্রী কৃষ্ণদাস মোদী, শ্রী মাধবদাস মোদী, শ্রী বি. ডি. ভোরা, শ্রী পি. বি. ভোরা, শ্রীমতী জয়া মোদী ও শ্রীমতী রসিকা মোদীর মত ঠাকুরের পরম ভক্তরা। তাই থেকে এলো আর এক উপলব্ধিঃ- এই সমস্ত হরনাথ প্রাণ ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে ছিলাম বলেও হয়তো দয়াল ঠাকুর নিজে না এসে পারলেন না। ভক্তরা যে তাঁর প্রাণ।……. মনে পড়ে গেল সেই ক’টা লাইন – “সেই ভক্ত ধন্য যে না ছাড়ে প্রভুর চরণ; সেই প্রভু ধন্য যে না ছাড়ে নিজ জন। দুর্দৈবে সেবক যদি যায় অন্য স্থানে; সেই ঠাকুর ধন্য তারে চুল ধরে আনে”।…………ধন্য আমার ঠাকুর; আর ধন্য তাঁর ভক্তবৃন্দ।
ব্লগ পোস্ট # ২৭; ২৫/১২/২০১৬: “বাবা (ঠাকুর হরনাথ) - আমার অক্ষয় রক্ষা কবচ”: আর. জি. প্রকাশ; ব্যাঙ্গালোর
“বাবা (ঠাকুর হরনাথ) – আমার অক্ষয় রক্ষা কবচ”: আর. জি. প্রকাশ; ব্যাঙ্গালোর
পাগল ঠাকুরের গভীর ভালবাসা আর অনুক্ষণ পিতৃসুলভ তত্ত্বাবধানের অনুভূতি আমার জীবনে এসেছে বারে বারে। সে সব যেমন আমার মন ভরে দিয়েছে, তেমনি জুগিয়েছে বাধা বিপত্তির সামনে ভেঙ্গে না পড়ার সাহস এবং আত্মবিশ্বাস। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি আমার বাবা আমার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। তবে সে সব অন্তরের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্যাতীত। তাই একটি সাম্প্রতিক একটি ছোট ঘটনার উল্লেখ করার সাহস করছি।
সোনামুখিতে নাম সপ্তাহম (অক্টোবর ২০১৬) থেকে বাড়ি ফিরে বেশ অসুস্থ বোধ করছিলাম। স্নেহের কিশোরকে ফোনে তা বলায় সে তক্ষুনি নিয়ে গেল হাসপাতালে। এক্স -রে রিপোর্ট দেখে ডাক্তাররা অনুমান করলেন নিউমোনিয়া আর আমাকে চিকিৎসার জন্য ICU তে ভর্তি করা হ’ল। টানা তিন দিন সেখানে থাকার পর অবস্থার খানিকটা উন্নতি লক্ষ্য করে আমাকে জেনারাল ওয়ার্ডে রেখে দু’ দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। বাড়ি ফিরে ভালোই বোধ করছিলাম। অভ্যাস মত ঘরের ভেতর হাঁটা চলা আর যথারীতি খাওয়া দাওয়াও ঠিকই ছিল। কিন্তু দু’ দিন পর থেকে অস্বাভাবিক শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করতে লাগলাম আবার। সে’ রাতে যখন তার জন্য দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না, কিশোরকে আবার বললাম। হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা হতভম্ব হয়ে গেলেন দু’টো ফুসফুসে এত শ্লেষ্মা জমে কি করে। তাঁদের বিচারে অবস্থা এতই গুরুতর ছিল যে আমেরিকাতে আমার ছেলেকে ফোনে করে অবিলম্বে ফিরে আসার পরামর্শ দেন। সেও হন্তদন্ত হয়ে প্রথম যে ফ্লাইটটা পেল তাতে চলে এলো। ডাক্তাররা তাকে পরিষ্কার জানালেন যে আমার শারীরিক পরিস্থিতি (বিশেষত আমার বয়েসের কারণে) অত্যন্ত গুরুতর আর অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসার পরও যে আমার জীবন রক্ষা পাবে এমন কোন প্রতিশ্রুতিও তাঁরা দিতে পারবেন না। কাজেই, তাকে পুরো ব্যপারটা ভালো করে ভেবে তাড়াতাড়ি মনস্থির করতে বলা হ’ল। ছেলে জানালো আমাদের ঈশ্বরের প্রতি আস্থার কথা এবং খরচা নিয়ে চিন্তা না করে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আরম্ভ করতে বলল।
১৫ দিন ধরে ICU তে চলল চিকিৎসা আর আমার শারীরিক অবস্থারও ধীরে ধীরে উন্নতি হতে থাকল। নিজে খানিক সুস্থ বোধ করায় এতদিন বিছানায় পড়ে থাকার পর আমার বেডের পাশে রাখা হুইল চেয়ারটায় কিছুক্ষণ বসার ইচ্ছে হ’ল। কাছের এক পুরুষ নার্সকে ডেকে বললাম আমাকে বসিয়ে দিতে। সে সযত্নে এবং নিয়ম মাফিক কায়দায় সহজেই আমাকে বসিয়েও দিল। ঘণ্টা খানেক বসার পড় একটু ক্লান্তি অনুভব করায় ঠিক করলাম বিছানায় উঠে শুয়ে পড়তে। কিনতি তখন সেই পুরুষ নার্সকে ধারে কাছে কোথাও দেখতে পেলাম না। অগত্যা দু’টি সিস্টারকে অনুরধ করলাম। দুজনে চেয়ারের দু পাশে দাঁড়াল এঁর একজনে কাঁধে এক হাত, অন্য জনের কাঁধে ওপর হাতটা রেখে ওঠার চেষ্টা করলাম। আন্দাজ করতে পারিনি যে আমার পায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই, আর দু পা দু দিকে যাচ্ছে। কাজেই আমার শরীরের সমস্ত ওজনটা গিয়ে পড়ল দুই সিস্টারের ওপর আর আমরা তিন জনে হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছি। ঠিক এমন সময়ে হটাতই কোথা থেকে এক বরিষ্ঠ সিস্টার এসে আমার পা দুটো ধরে স্বচ্ছন্দে বেডের ওপর তুলে দিল, যার ফলে আমিও সহজেই বিছানায় বসে পড়তে পারলাম। এক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক অবস্থা থেকে নিস্তার পেয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে সেই সিস্টারকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে মুখ তুলে দেখি সেখানে সে আর নেই। দুই সিস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম উনি কে। তারাও বলল তাকে তাড়া কখন দেখেনি। পরে হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার এবং কর্মচারীদেরও জিজ্ঞেস করলাম আমি আর বাড়ির লোকেরা। কিন্তু কেউই সেই চেহারার সঙ্গে মিল আছে এমন কোন নার্সের কথা বলতে পারল না। আর আমার বুঝতে বাকি রইল না আমাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে স্বয়ং আমার বাবা এসেছিলেন মহিলা নার্সের বেশে! আরেকবার প্রত্যক্ষ করলাম কেমন প্রতিটা মুহূর্তে তিনি আছেন তাঁর সন্তানদের রক্ষা করতে। আমরাই শুধু সব বেশে তাঁকে চিনে উঠতে পারি না। বাবার কৃপা এবং ভালবাসায় মৃত্যুপথ যাত্রী সেই আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। শারীরিক বলের জন্যে ভিটামিন আর প্রোটিন পাউডার ছাড়া এখন আর কোন ওষুধ পত্রও খেতে হয় না আমায়।
ব্লগ পোস্ট # ২৬; ১৩/১২/২০১৬ঃ “ভক্তের মনের দ্বন্দ্ব, ভ্রান্তি মোচন”
“ভক্তের মনের দ্বন্দ্ব, ভ্রান্তি মোচন”
লেখক: তিলক ঘোষাল
(এক হরনাথ-প্রাণ ভক্তের বিবরণের ভিত্তিতে লেখা)
আমার জীবনে ঠাকুরের অসীম ভালবাসার আর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন হ’ল এই শেষ বেলাতে আমাকে ২-৩ জন সম্পূর্ণ ভাবে হরনাথ-প্রাণ ভক্তের সংস্পর্শে এনে দেওয়া – যা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এক আত্মিক সম্পর্কে। এই জনাকয়েক ভক্তের সঙ্গে এখন যোগাযোগ হয় প্রায়ই – হয় টেলিফোনে আর ন’য় ই-মেলের মাধ্যমে। আর সব কথাই কেবল বড়বাবা বড়মা কে ঘিরে, যা মনে আনে প্রশান্তি। সম্প্রতি এমনই এক ‘গল্প গুজবের’ সময়ে তাঁদেরই একজন শোনালেন তাঁর পুত্রবধূর এক মন কাড়া অভিজ্ঞতার কথা। সেই ঘটনাটাই এখানে বলতে চলেছি। তবে সেই ভক্তের নিজের এবং পুত্রবধূর নাম প্রকাশের গভীর সংকোচকে সম্মান দিতে তা উহ্য রাখলাম।
বিয়ের পর মেয়েটি স্বভাবতই কুসুমহরনাথ জগতে প্রবেশ করে। আর শ্বশুর বাড়িতে সর্বক্ষণের কুসুমহরনাথ পরিবেশের মধ্যে সে চাক্ষুষ করলো আবালবৃদ্ধ প্রত্যেকটি সদস্যের ঠাকুর আর মায়ের প্রতি বিশ্বাস, ভালবাসা আর ভক্তির গভীরতা। নিশ্চয় তার ভাগ্যে লেখা ছিল ঠাকুর তাকেও নিজের গোষ্ঠীতে টেনে নেবেন (তাঁর সেই উক্তি – “I shall choose my own flock”)। আর তাই ধীরে ধীরে, কিন্তু অতি স্বচ্ছন্দে সে মিলে মিশে গেল হরনাথ সম্প্রদায়ে। গুরুজনদের কাছে ঠাকুরের কথা শুনে ও নিজে পড়ে সে হৃদয়ঙ্গম করলো তাঁর একমাত্র উপদেশ – অহরহ কৃষ্ণ নাম। আর এইখানেই বাধল খটকা। তার মনে ঘোরা ফেরা করতে থাকল একটাই প্রশ্ন – কি করে ‘ভগবান’ হিসেবে মেনে নেওয়া যায় এমন একজনকে (কৃষ্ণ) যিনি না কি ১৬১০৮ টি কন্যাকে বিবাহ করেছেন! এক উচ্চ শিখিত, আধুনিক মানসিকতার মেয়ের মন সে’টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। আর তার পরই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনা। সেই হরনাথ প্রাণ ভক্তের ছেলে এক দিন ফোনে তাঁকে উত্তেজিত কণ্ঠে জানাল তার স্ত্রীর সে’দিন সকালের এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার কথা আর সেটা সে তাঁকে সরাসরি তার স্ত্রীর মুখ থেকেই শুনতে বলল। পুত্রবধূ যখন ফোন ধরল শ্বশুর মশাইকে সে কথা বলতে, সকালের সেই অভিজ্ঞতার ঘোর তখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। কাঁপা কাঁপা গলায় যা জানাল সে’টা হ’ল এই রকম-
অন্যান্য দিনের মত সে’ দিনও সে ঠাকুর ঘরে সকালের পূজায় ব্যস্ত। মনে কিন্তু রোজকার মতই ঘোরা ফেরা করে চলেছে কি করে ঠাকুরের কথা মত ১৬১০৮ বার বিবাহিত কৃষ্ণের নাম করা যায়। খানিক পরে মনে হল কে যেন কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। চমকে ঘুরে সে দেখে পিছনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে স্বয়ং ঠাকুর হরনাথ। দেহ, মন সব অবশ হয়ে গেল। কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই পুজোর বেদিতে রাখা কৃষ্ণের ছবির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে এক কোমল কণ্ঠে ঠাকুর বললেন – “মাগো, ও আর আমি যে একই রে”! আর তারপরেই তিনি মিলিয়ে গেলেন – হটাতই যেমন এসেছিলেন, তেমনি ভাবেই। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সে – শরীর, মন কাঁপছে বাতাসে পাতার মত। নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না সে। কিন্তু, একই সঙ্গে মুহূর্তে মিটে গেল তার মনের এতদিনের দ্বন্দ্ব, ভ্রান্তি!
এখানে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। মেয়েটি একজন শিক্ষিত, বড় কোম্পানিতে উচ্চ পদে কর্মরত পেশাদার, যাকে একা কাজে ঘুরেও বেড়াতে হয় দেশে, বিদেশে। এক কথায়, একজন বুদ্ধিমন্তা, চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী, আধুনিক মানসিকতার মানুষ। কাজেই তার মত ভক্তের মনের দ্বন্দ্ব ঘোচানোর জন্যে ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু না বলে হয়তো ঠাকুরকে এমন সোজাসুজি বলার পথই বেছে নিতে হয়েছিল। সত্যি, স্নেহময় পাগল ঠাকুরকে কত ধরনেরই না উপায় বার করতে হয় তাঁর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ভক্তের মনের বিভিন্ন সন্দেহ, দ্বন্দ্ব মেটাতে।
ব্লগ পোস্ট # ২৫; ২৭/১১/২০১৬ - “চির পথপ্রদর্শক ঠাকুর হরনাথ”: ঠাকুরের নাতি শ্রী বিজয়কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা
“চির পথপ্রদর্শক ঠাকুর হরনাথ”: ঠাকুরের নাতি শ্রী বিজয়কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা
(ঠাকুরের নাত বউ শ্রীমতি ধীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনার ভিত্তিতে তিলক ঘোষালের লেখা)
এখানে যে ঘটনাটির উল্লেখ করতে চলেছি সে’টি ন’মামিমার (শ্রীমতী ধীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের) স্মৃতি চারণের সময়ে আমাকে সম্প্রতি বলা মামার (ঠাকুরের নাতি শ্রী বিজয় কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের – পুরনো ভক্তদের বিজুদার) জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা। এটা প্রকাশ করছি মামিমার হার্দিক সম্মতি পাবার পরই।
ন’মামা ছিলেন একটু রাগি প্রকৃতির মানুষ আর যাদের মনে প্রাণে ভালবাসতেন তাদের ওপরই বেশীর ভাগ পড়ত তার কোপ। ঠাকুর আর মায়ের ব্যাপারে মামার দৃঢ় বিশ্বাস ইচ্ছে ছিল যে চারিদিকে তাঁদের নামের প্রচার হওয়ার খুব জরুরি প্রয়োজন, যাতে হরনাথ গোষ্ঠীর বাইরের আরও পাঁচটা তাপিত মানুষও তাঁদের কৃপা, ভালবাসা আর নিরাপত্তার ছত্র ছায়া পেতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন দিক থেকেই তেমন কোন উদ্যোগ দেখতে না পেয়ে ধীরে ধীরে একটা গভীর ক্ষোভ জমে উঠে ছিল মনে যে ভক্তরা শুধু নাম গান, ভজন, কীর্তন নিয়েই ব্যস্ত, “আসল কাজে” কারুরই মন নেই। সুতরাং বিভিন্ন যায়গা থেকে ভক্তরা যখনই সোনামুখি গিয়ে মামার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন, কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরই সেই ক্ষোভ ফেটে পড়ত আর মামা অনেক কটুশব্দে তাঁদের তিরস্কার করতেন। এতে ধীরা মামিমা যেমন প্রচণ্ড অপ্রস্তুত বোধ করতেন তেমনই মনে জাগত ভীষণ ভয় যে ভক্তের মনে কষ্ট দেওয়ায় এই বুঝি সংসারে এলো কোন ভয়ানক অমঙ্গল। অনেকবার মামাকে অনুরোধ করেছেন এমনটা না করতে। মামাও বুঝতেন, কিন্তু প্রচারের কোন কাজ হচ্ছে না বলে মনে এমনই একটা নৈরাশ ছিল যে নিজেকে সামলাতে পারতেন না অনেক সময়ে।
মামারা (মানে, মামা, মামিমা আর ছেলে রানা) থাকতেন সোনামুখির ‘বিশের বাড়ির’ এক তলায়। সব ভক্তরাই চেনেন হরনাথ শান্তি কুটিরের প্রায় সামনা সামনি ঐ দোতলা মাটির বাড়িটা। দুটো ছিমছাম ঘর, সামনে ছোট্ট একটা বারান্দা আর এক ফালি বাগান। ঐ বারান্দাতে বসেই হ’ত সকলের সঙ্গে কথা বার্তা, গল্প গুজব। যে ঘটনাটার উল্লেখ এখানে করতে চলেছি, তা ঘটে ছিল এই ‘বিশের বাড়িতেই’ – ১৯৮০ বা ‘৮১ সালে। এক রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর মামা বললেন যে ঘুম আসছে না তাই কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে একটু পরে শুতে যাবেন। মামিমা গিয়ে শুয়ে খানিক পরে ঘুমিয়েও পড়লেন। পরের দিন সকালে মামিমা লক্ষ্য করলেন মামা ভীষণ চুপ চাপ হয়ে গেছেন আর ভীষণ অন্য মনস্ক। অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে বুঝে মামিয়া অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন সব কিছু খুলে বলে মনটা হাল্কা করতে। প্রথমে কিছু নয়, কিছু নয় বলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে শেষে বললেন – “কাল রাতে একটা অভাবনীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে’। আর যা বললেন, তাএই রকম………..
মামা বারান্দায় বসে। রাত গভীর হচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া চারিদিক নিস্তব্ধ নিথর। খেয়াল নেই কতক্ষণ এই ভাবে কাটার পর হটাতই মনে হ’ল কে যেন একটা আলতো করে কাঁধে হাত রাখল। ঘুরে দেখে খুব একটা কিছু ঠাহর করতে পারলেন না, আর তার পরই পরিষ্কার অনুভব করলেন কানের কাছে একটা উষ্ণ নিশ্বাস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কানে ফিসফিস করে কে বলে উঠলো – “বাবা, আমার নাম প্রচারের জন্য এত কেন মাথা ঘামাচ্ছিস তুই। ঐ নিয়ে চিন্তা ছাড়”…… ব্যস এ’টুকুই। তারপরই যেমন হটাতই এসেছিল, তেমনি সরে গেল কাঁধের ওপর থেকে সেই হাত, বন্ধ হ’ল সেই নিশ্বাস আর সেই ফিসফিস স্বর। মামা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ !
তারপর দিন থেকে মামা এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। আমৃত্যু আর কোন দিন মুখে আনেন নি তাঁদের নাম প্রচারের কথা !
ব্লগ পোস্ট # ২৪; ১২/১১/২০১৬ - “কর্তা মায়ের অপরূপ অভয় আশ্বাস”: শ্রী পল্লব কুমার মিত্র (বুলবুল), কোলকাতা
“কর্তা মায়ের অপরূপ অভয় আশ্বাস”: শ্রী পল্লব কুমার মিত্র (বুলবুল), কোলকাতা
(পল্লব কুসুমহরনাথ ভক্ত চূড়ামণি শ্রী লালগোপাল মিত্রের (অনেকের লালু দাদাবাবু) নাতি)
হরনাথ ঠাকুর আর মা কুসুমকুমারীকে আমাদের পরিবারে চার প্রজন্ম ধরে সকলেই কর্তা বাবা আর কর্তা মা বলেই জানে। আমার দাদু শ্রী লালগোপাল মিত্র ছিলেন কর্তা মায়ের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। দাদু ওনাকে দিদিমা বলে ডাকতেন। যেমন মা ভালবাসতেন দাদুকে, তেমনি দাদুর ছিল তাঁর দিদিমার প্রতি অগাধ ভক্তি আর পরিপূর্ণ নির্ভরতা। এখানে যে ঘটনাটির উল্লেখ করতে চলেছি তা আমার ঠাকুমার (আবালবৃদ্ধপুরনো ভক্তদের অত্যন্ত আদরের ‘কাপুদি’) মুখে আমার নিজের কানে শোনা ।
দাদু চাকরী করতেন সে যুগের পাক্কা বিলিতি কোম্পানি Bird & Heilgers এর ক্যাশিয়ার পদে। একবার কর্তা মা বোম্বাই যাচ্ছেন সন্ধ্যের ট্রেনে। অফিস শেষ করেই দাদু ছুটলেন হাওড়া স্টেশন কর্তা মাকে ‘সী-অফ’ করতে। সেখানে কলকাতা এবং শহরতলির আরও অনেক ভক্তও রয়েছেন একই কারণে। আর মাকে ঘিরে চলছে কথাবার্তা, গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টা। কিন্তু যেই ট্রেন ছাড়ার সময় হল, কর্তা মা আচমকাই দাদুকে বললেন – “লালু তুই উঠে আয়’। মহা ফাঁপরে পড়ে গেলেন দাদু। মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন – “কিন্তু দিদিমা আমার কাছে যে অফিসের ক্যাশ বাক্সের চাবি। সেটা কারুর হাতে না দিলে সব কাজকর্মে আটকে যাবে। তার ওপর বিনা অনুমতিতে এতদিন অফিস কামাই করাও বিপজ্জনক। বাড়িতেও কেউ জানেনা। সঙ্গে টাকাকড়ি বা জামা কাপড়ও কিছুই নেই। কি করে যাই দিদিমা?” কর্তা মা বললেন – “তোকে আমি উঠতে বলছি কি না?” আর রা টি না কেড়ে দাদুও উঠে পড়লেন ট্রেনে। তবে যতই হোক, Bird & Coর মত একটা কড়া বিলিতি কোম্পানিতে এ’রকম একটা বেনিয়ম কাজ আর জাঁদরেল সাহেব কর্তাদের দুশ্চিন্তা মনে ঘোরা ফেরা করতেই থাকল। দাদু নিশ্চিত হয়ে গেলেন ফেরত যাওয়া মাত্র চাকরী থেকে বরখাস্ত হ’বার চিঠিটা হাতে পাবেন। আবার নতুন চাকরীর চেষ্টা করতে হবে। এদিকে এক ভক্তের মুখে দাদুর বোম্বাই রওনা হবার কথা শুনে বাড়িতে ঠাকুমা হতবাক হয়ে গেলেন এই ভেবে যে কি মানুষটা কি করে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করতে পারলো, আর চাকরীটা গেলে এত বড় একটা সংসারই বা চলবে কি করে।
যাই হোক দিন দশেক পরে দাদু কোলকাতা ফিরলেন। দুরুদুরু বুকে পরের দিন অফিস গেলেন, এক রকম নিশ্চিত যে চাকরীটা গেছে। চুপ চাপ গিয়ে ক্যাশ বাক্সের চাবি খুলে বসে পড়লেন কাজে – মনে চলছে এই বুঝি ডাক পড়ে এত দিন কামাই করার জবাবদিহি করতে। সময় গড়িয়ে চলছে অথছ না কোন বড় সাহেব না কোন সহকর্মী সে ব্যাপারে কথাতা পর্যন্ত তুলছে না। এমন ভাব সকলের যেন কিছুই হয় নি। এতে যদিও কিছু অস্বস্তি বোধ করছিলেন দাদু, কিন্তু দুশ্চিন্তার মেঘও একটু একটু করে কাটছিল। এই করে করে সারাটা দিন কেটে গেল অন্যান্য পাঁচ দিনের মতই। চাকরী যাওয়া তো দূরের কথা, এত লম্বা কামাইয়ে কেউ কোন উচ্চবাচ্চা পর্যন্ত করলো না ! দাদু বুঝলেন ঐ দশ দিন ধরে সবাই এক লালগোপাল মিত্রকে ক্যাশে বসে কাজ করতে দেখেছিল, ওনার উপস্থিতি কেউ ধরতেই পারে নি। কি অপরূপ ভাবে বোঝানো যে কুসুমহরনাথ কমল চরণ আশ্রিত ভক্তের কোন বিষয়েই দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। জয় শ্রী কুসুমহরনাথ
ব্লগ পোস্ট # ২৩; ২৫/১০/২০১৬- “স্বামী (বাবা) - আমাদের চির রক্ষক" - শ্রীমতি ভি. এস. সনৎ কুমারী, ব্যাঙ্গালোর
“স্বামী (বাবা) – আমাদের চির রক্ষক – শ্রীমতি ভি. এস. সনৎ কুমারী, ব্যাঙ্গালোর
(অনুবাদ এবং সম্পাদনা তিলক ঘোষাল ও শ্রীমতী সনৎ কুমারীর তা অনুমোদনের পরই এ’টি পোস্ট করা হ’ল)
kusumharaleelas.com ব্লগ সাইটের ১৫ নং পোস্ট আমার নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং আমাদের জীবনে বাবা ঠাকুর হরনাথ ও মা কুসুমকুমারীর অনেক লীলার মধ্যে কয়েকটি তাঁদের অগণিত ভক্ত বৃন্দের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। আজ আরও দু’টি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই যা আবার স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে তাঁরা কি ভাবে আমাদের ওপর প্রতিনিয়ত নজর রেখে বিপদ থেকে ক্রমাগত উদ্ধার করে চলেছেন।
প্রথম ঘটনা
এক সন্ধ্যে বেলা আমার স্বামী আর আমি আমাদের স্কুটারে বাড়ি ফিরছি। সেই সময় রাস্তায় যানবাহনের প্রচণ্ড ভিড়। আর ট্রাফিকের এই জটলার মধ্যে হটাতই দেখি উল্টোদিক থেকে আমাদের স্কুটারের ঠিক মুখোমুখি এগিয়ে আসছে বিরাট একটা গরু। রাস্তার এক দিকে বড় বড় চলন্ত গাড়ি, বাস, ট্রাকের ভিড় আর অন্যদিকে স্তূপাকার করে রাখা রয়েছে লোহার রড, বার ইত্যাদি – বোধহয় রাস্তা মেরামতের কাজের জন্যে। কাজেই কোনদিকেই বেরোবার পথ নেই। ধাক্কায় উলটে পড়ে গাড়ির তলায় চাপা পড়ে নিজেদের মৃত্যুর মুখোমুখি দেখতে পাচ্ছি। এইরকম একটা অবস্থায় যখন আমরা ভয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ, দেখি গরুটা আচমকাই বাঁ দিকে ঘুরে গেল সেই সব লোহা লক্কড়ের মধ্যে। ঠিক যেমন প্রচণ্ড বলশালী কেউ শিং ধরে তার মুখটা ঘুরিয়ে দিলে হয়, ঠিক সেই রকম। অথছ কাউকেই দেখতে পেলাম না গরুটার ধারে কাছেও ! কি করে যে এমন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত রক্ষা পেলাম ভেবে হতভম্ব হয়ে গেলাম।……… আজও যখন সে ঘটনার কথা মনে পড়ে, আমার দু চোখ ভরে আসে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতায়। এখন আমি রোজ মা আর বাবার ছবিতে পদসেবা করি। কেননা সন্তানদের এমন অহরহ বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে করতে কি তাঁদের একটু গা হাত পায়ে ব্যথা বা খানিক ক্লান্তি বোধ হয় না? এই ভেবেই করে চলেছি।
দ্বিতীয় ঘটনা
একবার আমি, আমার স্বামী, দাদা/বউদি আর দিদি/জামাইবাবু – এই ৬ জন মিলে সিঙ্গাপুর বেড়াতে যাই। কিন্তু সেখানে পৌঁছে এয়ারপোর্টের মধ্যেই আমার স্বামীর হটাত একটা স্ট্রোক হয়। সেখানকার ডাক্তাররা দেখে শুনে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে বললেন। আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করি। এক দিকে একটা স্ট্রোক পেসেন্ট যাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন আবার অন্যদিকে এমন একটা বিদেশ বিভূঁই যেখানে না আছে আমাদের কোন পরিচিত লোক আর নাই হাতে যথেষ্ট টাকাকড়ি। তার ওপর ভাষার সমস্যা আর এক প্রচণ্ড অসুবিধে। যাইহোক, সাত পাঁচ ভেবে ওদের বললাম আমারা পরের দিন সকালের প্রথম ফ্লাইটেই দেশে ফিরে যাব আর সেখানেই ওনাকে ভর্তি করব। চটপট ফেরার বুকিং কনফার্মও করা হ’ল – আর তারপর শুরু হল সকালের জন্যে আমাদের অন্তহীন অপেক্ষা। আর সেই মানসিক অবস্থায় যা আমরা একমাত্র করতে পারতাম তাই শুধু করে চললাম সকলে – অবিরত ‘কুসুমহর’ নাম জপ। বাবাকে বলে চললাম আমার স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে।
যেমন যেমন রাত বাড়তে লাগলো ওনার শরীরে সামান্য নড়াচড়া লক্ষ্য করতে লাগলাম। আরও কিছু সময় কাটার পর মনে হ’ল যেন অবস্থার একটু একটু করে উন্নতি হচ্ছে। আর আমাদের সকলকে হতবাক করে সূর্যোদয়ের সময় সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ হয়ে উঠে বসলেন উনি! কি করে এমন একটা স্ট্রোক পেশেন্ট এত তাড়াতাড়ি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে? তাও আবার চিকিৎসা ছাড়াই? বাবার তাঁর লীলা আরেকবার প্রকট করলেন আমাদের চোখের সামনে ! উনি যে কতটা সুস্থ হয়ে উঠে ছিলেন তার আন্দাজ এই থেকে পাঠক পাবেন যে আমাদের সিঙ্গাপুর ভ্রমণ সূচিতে এক রত্তি পরিবর্তন করতে তো হয়ই নি, বরং আমরা সেন্টোসা দ্বীপ পর্যন্ত ঘুরে এলাম, যেখানে উনি একটা পার্কের সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেলেন বিন্দু মাত্র অসুবিধে অনুভব না করে। বাবার তো কত লীলাই দেখেছি নিজের জীবনে। কিন্তু মনে হয় এই অভিজ্ঞতাটাই হয়তো আমাকে এক অন্য মানুষ করে দেয়। কারণ এর পরই তাঁদের কমল চরণে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করার পথে আরও গতি আসে। সন্তান সন্ততিদের প্রতি তাঁদের ভালবাসার কোন সীমা পরিসীমা নেই……
ব্লগ পোস্ট # ২২; ১৬/১০/২০১৬ - “প্রভুজীর কৃপায় বালাজী দর্শন ইচ্ছা পূর্তি”: শ্যামলী চ্যাটার্জি, বাঁকুড়া
“প্রভুজীর কৃপায় বালাজী দর্শন ইচ্ছা পূর্তি”: শ্যামলী চ্যাটার্জি, বাঁকুড়া
অক্টোবর ২০১২ সালের কথা। আমার ছোট ছেলে তখন চেন্নাইয়ে TCS কোম্পানিতে চাকরী করতে করার সময়ে তাম্বরম স্টেশনের কাছে সে একটা ফ্ল্যাট কেনে। তারই গৃহ প্রবেশ উপলক্ষে আমি, আমার স্বামী, আমার ছোট বোন, তার স্বামী এবং তাদের ছোট্ট দুই মেয়ে চেন্নাই যাই। সেখানে থাকাকালীন একদিন বালাজী দর্শনের জন্যে সকলে সক্কাল সক্কাল বাসে করে বেরিয়ে পড়লাম তিরুমালার উদ্দেশ্যে। মন্দিরে পৌঁছে যথারীতি ‘স্পেশাল’ দর্শনের টিকিট কেটে আরও শয়ে শয়ে লোকের সঙ্গে লাইনে দাঁড়ালাম গর্ভ গৃহে ঢোকার জন্যে। লাইন খানিক এগোবার পর লোকের মুখে জানতে পারলাম যে মন্দিরের ভেতরে ক্যামেরা এবং মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমাদের সঙ্গে ক্যামেরা ছিল না ঠিকই, কিন্তু আমার আর আমার বোনের হাতে ফোন ছিল। যাক, শুধু ঠাকুরের ছবিই তো তোলা হবে না, এই ভেবে আমরা ফোন দু’টো অফ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। ফোনের জন্যে যে আমাদের দর্শনটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবার মুখে তা আঁচ করতে পারি নি তখনো ! একে তো লাইনে শম্বুক গতিতে এগোচ্ছে, তার ওপর ভয়ঙ্কর গরম। নাজেহাল অবস্থায় কোনরকমে শেষে পৌঁছলাম প্রথম গেটে। দেখি সেখানে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে সকলের ব্যাগ চেক হচ্ছে। খুব ভয় পেয়ে গেলাম বালাজী দর্শনের এতদিনের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে যাবে ভেবে। মনে মনে তখন অবিরত শুধু চলেছে বিপদতারণ কুসুমহরনাথের নাম। এই ভাবে ‘কুসুমহর, কুসুমহর’ করতে করতে কি ভাবে যে মেটাল ডিটেক্টর পেরিয়ে অত শত লোকের সঙ্গে আমরাও ভেতরে ঢুকে গেলাম ওয়েটিং এরিয়ার মধ্যে বুঝে উঠতে পারলাম না। যাক, ফাঁড়া কেটে যাওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
রাত ১০ টা নাগাদ মন্দিরের গেট খুলল আর সবার সঙ্গে আমরাও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম, ‘গোবিন্দা, গোবিন্দা’ জয়ধ্বনি দিতে দিতে। কিন্তু একটু এগোতেই বুঝলাম সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ। মন্দিরে ঢোকার মুখে আবার মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চলছে প্রত্যেক দর্শনার্থীর আলাদা আলাদা করে জোরদার তল্লাসি। দেখেই বুঝলাম আমাদের ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। তীরে এসে ভরাডুবি দেখে ভেঙ্গে পড়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলাম ‘কুসুমহর, কুসুমহর’ করতে করতে। দম বন্ধকরা ভিড়ের মধ্যে দর দর করে ঘামছি আর কাঁদছি। আর ‘কুসুমহর’ আওড়াতে আওড়াতে কাঁদছে বোনের ঐ ছোট্ট মেয়ে দুটোও। শেষে ঠাকুরকে বললাম ‘তুমি তো বল – ‘আমি রে তোদের কাছে নিতি আছি পাছে পাছে’…..তাহলে এই বিপদ থেকেও উদ্ধার করে দর্শন করিয়ে দাও প্রভু”। এমনই সময়ে লক্ষ্য করি অধীর জনতা একসঙ্গে ঢোকার চেষ্টায় একটা ছোট খাটো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখি আমাদের সামনে পুঁটলি পাটলা নিয়ে এক সাধুবাবাদের দলও গেটের ঠিক মুখে। কি ভেবে কে জানে দুই বোন সজোরে ছুটলাম সেই দলটার ঠিক মাঝখান দিয়ে আর ছিটকে চেক পোস্ট পেরিয়ে ঢুকে গেলাম অনেকটা ভেতরে। কিন্তু মেটাল ডিটেক্টর তো আমাদের ফোনের খবর জেনে ততক্ষণে পোঁ পোঁ শুরু করেছে। আর তাতেই আটকে গেলেন সাধুবাবারা। খুব অপরাধী মনে হতে লাগলো। একটু আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখতে থাকলাম কি দাঁড়ায়। শেষে কিছু না পাওয়াতে ওনারাও ছাড়া পেলেন। স্বস্তিতে অপরাধ বোধ একটু কমলো। আমাদের বালাজি দর্শন অভিলাষও পূর্ণ করলেন আমার প্রভু। তাঁর পায়ে শত শত প্রণাম জানিয়ে আমাদের অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইলাম। প্রভুজী যে কি ভাবে আমাদের ইচ্ছা পূরণ করেন তা আবার উপলব্ধি করলাম। তাঁর পদে যেন আমাদে সদা মতি থাকে, শুধু এই প্রার্থনা।
ব্লগ পোস্ট # ২১; ২৫/০৯/২০১৬ - “মরণ এসে লভে জীবন, ভক্ত মুখে শুনতে পাই”: হরেশভাই জাভেরি, মুম্বাই
“মরণ এসে লভে জীবন, ভক্ত মুখে শুনতে পাই”: হরেশভাই জাভেরি, মুম্বাই
(বাংলা অনুবাদঃ তিলক ঘোষাল)
১৯৬৮ সালের কথা। আমি তখন ২২ বছরের আর আমার ছোট ভাই প্রদীপের বয়স ১০ এর কাছাকাছি। ও বাড়ির গাড়িতেই স্কুল যাতায়াত ক’রত। এক দিন গাড়ি মেরামতে গিয়েছিল বলে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরছিল। পথে খানিক পরে ও লক্ষ্য করে উল্টো দিক থেকে একটা বাস আসছে। কিন্তু সেটা যেই ট্যাক্সির কাছাকাছি আসে, বাস ড্রাইভার আচমকাই কেমন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আর বাসটা মুখোমুখি সবেগে ধাক্কা মারে ট্যাক্সিটাকে। ট্যাক্সি ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর প্রদীপ, যে ছিল ঠিক তার পিছনের সীটেই, আহত হয় ভীষণ গুরুতর ভাবে – মাথায় খুলিতে ফ্র্যাকচার আর হাসপাতালে পৌছুতে পৌছুতে সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন (কোমাটোস) অবস্থা। আবার এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছিল বমি, যার ফলে পেটের থেকে উঠে আসা জিনিস শ্বাস নালি ভরে দিয়েছিল। সুতরাং, অন্যান্য সব কিছু ছেড়ে ওর শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখতে আগে ডাক্তারদের করতে হ’ল একটা ট্র্যাকিওটমি (গলার সামনের অংশ কেটে একটা টিউব ঢুকিয়ে সোজাসুজি ফুসফুসে হাওয়া যাবার জন্যে একটা পথ তৈরি করা)। মাথার খুলি ছাড়াও শরীরের নানান অংশেও ছিল বহু ফ্র্যাকচার। বিপত্তির শেষ এখানেই নয়। অপারেশনে চলাকালীনই দু’ দু’বার ওর হার্ট ফেল করে। ডাক্তাররা কোনওরকমে আবার তা চালু করেন। সব মিলিয়ে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে প্রদীপ মৃত্যুর একেবারে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তারবাবুরা কঠোর পরিশ্রম করছিলেন, কিন্তু ওর বাঁচার কোন সম্ভাবনা দেখতে পারছিলেন না। আমাদের মা, রুক্মিণী দেবী, কিন্তু এ’সব ‘বাস্তবিক’ কথা বার্তা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন – এমনই ছিল তাঁর ঠাকুরজীর ওপর বিশ্বাস। টানা তিন দিন, তিন রাত্রি ধরে চলল প্রদীপের শরীরে একটার পর একটা অপারেশন। আর মা ঠায় বসে রইলেন অপারেশন থিয়েটারের বাইরে – শুরু থেকে শেষ অবধি – এক ফোঁটা জল পর্যন্ত মুখে না দিয়ে। মায়ের ঠোঁট শুধু আউড়ে যাচ্ছিল – “কুসুমহর স্মরনম মম….কুসুমহর স্মরনম মম”।
চতুর্থ দিন, অগুন্তি অপারেশনের পর, প্রদীপকে OT থেকে এমারজেন্সি ওয়ার্ডে বদলী করা গেল। যদিও ডাক্তাররা ওর এই অভাবনীয় ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারায় নিজেরাই ভীষণ অবাক ছিলেন, ওনারা জানতেন প্রদীপের ভবিষ্যৎ জীবন কিন্তু শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে মোটেই স্বাভাবিক হ’বে না। মা কিন্তু ঠিক আগের মতই, আবারও এ সব অশুভ ভাবনাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিলেন না। তিনি নিশ্চিত ছিলেন প্রদীপ আর পাঁচ জনের মতই বড় হবে এবং একেবারে স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে।
এর এক বছর পর মা সেই প্রদীপকে সোনামুখি নিয়ে গিয়ে শ্রী মন্দিরে প্রণাম করিয়ে আনেন। আর মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসা প্রদীপ এখন দু’টো মিষ্টি মিষ্টি নাতি নাতনির দাদু ! তাঁর রাজ্যের প্রজা আমরা। আমাদের কিসের চিন্তা, কিসের ভয়?……… জয় শ্রী কুসুমহরনাথ